মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
স্বাস্থ্যসাথী কার্ড গ্রহণ না-করা নিয়ে কড়া পদক্ষেপ করার বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার বিধানসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে রাজ্যের ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়েও মুখ খুলেছেন তিনি।
রোগীদের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড প্রত্যাখ্যান করায় অতীতে বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এমনকি, এ নিয়ে আইন প্রয়োগ করে প্রয়োজনে হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিলের নির্দেশিকাও জারি করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। অভিযোগ, তার পরেও টনক নড়েনি বিভিন্ন হাসপাতালের। সোমবার বিধানসভার অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড গ্রহণ করতে হবে রাজ্যের বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে। তা না-করলে বাতিল করা হবে ওই বেসরকারি হাসপাতালগুলির লাইসেন্স। স্বাস্থ্যসাথী নিয়ে বিধানসভায় একটি প্রশ্ন করেছিলেন শিলিগুড়ির বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ। সেই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েই কড়া এই পদক্ষেপের কথা জানান মমতা। ২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই প্রকল্পের সূচনা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যবাসীকে নিখরচায় স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া। কিন্তু স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডে চিকিৎসা পরিষেবা পেতে বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালে ভোগান্তির মুখে পড়তে হয় বলে প্রায়শই অভিযোগ করেন রোগীর পরিজনেরা। এই সমস্যার সমাধান করতে চলতি বছরের মার্চ মাসে ‘প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ইউনিট’ (পিএমইউ) গড়ার কথাও ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার। পিএমইউ গঠন হয়ে গেলে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ফিরিয়ে দেওয়া নিয়ে যে সমস্ত হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, তাদের বিরুদ্ধে চটজলদি ব্যবস্থা নিতে পারবে সরকার। কোনও হাসপাতালে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড না-নেওয়া হলে তা কেন নেওয়া হচ্ছে না, তা-ও জানতে চাইবে এই পিএমউই। অনলাইন এবং অফলাইন—দু’টি পদ্ধতিতে নিজেদের অভিযোগ জানাতে পারবেন সাধারণ মানুষ। ইতিমধ্যেই তা নিয়ে কাজ অনেকখানি এগিয়েছে বলে সরকারি সূত্রে খবর। তার মধ্যেই স্বাস্থ্যসাথী কার্ড গ্রহণ না-করা নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করার বার্তা দিলেন মমতা।
অন্য দিকে, রাজ্যে ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়েও আলোকপাত করেন মমতা। অধিবেশন কক্ষে ডেঙ্গি নিয়ে বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ, মুকুটমণি অধিকারীর প্রশ্নের জবাবে মমতা বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত বোর্ড গঠন না হওয়ার কারণেই সমস্যা হচ্ছে। পঞ্চায়েত কাজ করতে পারছে না।’’ এই প্রসঙ্গে দ্রুত পঞ্চায়েত বোর্ড গঠনের কথাও বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি, বিধাননগরের মতো ঝকঝকে শহুরে এলাকায় ডেঙ্গির প্রকোপের কারণ সম্পর্কেও মুখ খুলেছেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বিধাননগরের মেট্রোর কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। তাই সেখানে জল জমে ডেঙ্গি বেশি হচ্ছে।’’ পুরসভাগুলিকেও মশাবাহিত এই রোগ প্রতিরোধে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার বার্তা দিয়েছেন তিনি।
স্বাস্থ্যসাথীতে কড়া মমতা
স্বাস্থ্যসাথী নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উঠেছে। বিধানসভার অধিবেশনে এই সংক্রান্ত একটি প্রশ্ন তোলেন শিলিগুড়ির বিধায়ক। তাঁর প্রশ্নেরই জবাবে সোমবার মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড গ্রহণ করতে হবে রাজ্যের বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে। আর তা না-করলে বাতিল করা হবে ওই বেসরকারি হাসপাতালগুলির লাইসেন্স।
ডেঙ্গি প্রসঙ্গে মমতা
প্রতি বছরই বর্ষার মরসুমে কলকাতা-সহ রাজ্যে উদ্বেগ বৃদ্ধি করে ডেঙ্গি পরিস্থিতি। এ বছরও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। মশাবাহিত রোগে ইতিমধ্যেই কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে। সেই আবহে ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ে বিধানসভায় মুখ খুললেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত আট জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গির কারণে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৮৯৭ জন। ডেঙ্গি ঠেকাতে দফায় দফায় প্রশাসন পর্যালোচনা চালাচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। সোমবার ডেঙ্গি নিয়ে বিধানসভায় বিক্ষোভ দেখায় বিজেপি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করে নতুন করে ডেঙ্গি প্রসঙ্গ তোলেন। সেই সময়ে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় শুভেন্দুর উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনি যখন অধিবেশনে ছিলেন না তখন মুখ্যমন্ত্রী জবাব দিয়েছেন।’’ এর পরেই অধিবেশন থেকে ওয়াক আউট করে বিজেপি পরিষদীয় দল।
উত্তরবঙ্গেও আইডি হাসপাতাল
সংক্রামক ব্যাধির চিকিৎসার জন্য কলকাতার বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের সুনাম রয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসেন বহু মানুষ। সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য একাধিক উন্নত এবং আধুনিক প্রযুক্তির বন্দোবস্ত এই হাসপাতালটিতে আছে। করোনাকালে এই হাসপাতালের উপরেই নির্ভর করেছিল স্বাস্থ্যভভন। এই হাসপাতালকেই প্রথম কোভিড হাসপাতাল হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কলকাতায় এমন হাসপাতাল থাকলেও উত্তরবঙ্গে তেমনটা নেই। আগামী দিনে উত্তরবঙ্গেও আইডি হাসপাতাল তৈরি করা হবে। সোমবার বিধানসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে এমন পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
নতুন বিমানবন্দর
রাজ্যে নতুন বিমানবন্দর তৈরি করা হবে। সোমবার বিধানসভার অধিবেশনে এমন পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিধানসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে আলিপুরদুয়ারের কুমারগ্রামের বিজেপি বিধায়ক মনোজ ওরাওঁ তাঁর এলাকার উন্নয়ন সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। বিমানবন্দর নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বিমান চলাচল প্রসঙ্গে জানতে চান ইংরেজবাজারের বিধায়ক শ্রীরুপা মিত্র চৌধুরী। এই সব প্রশ্নের জবাবে মমতা বলেন, ‘‘কোচবিহার, বালুরঘাটে বিমানবন্দর তৈরির কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। মালদহের কাজও শেষ পর্যায়ে। এর পর হাসিমারাতেও একটি বিমানবন্দর তৈরি করার কথা ভাবা হচ্ছে।’’ মুখ্যমন্ত্রী আরও জানান, অন্ডালে একটি কার্গো বিমানবন্দর চালু করা হবে। বিমানবন্দর তৈরি হবে পুরুলিয়াতেও। তবে এ জন্য বাংলার বিজেপি বিধায়কদের উদ্যোগী হতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘বিমানবন্দর তৈরির জন্য আপনারা (বিজেপি বিধায়ক) দ্রুত দিল্লি থেকে ছাড়পত্রের বন্দোবস্ত করুন। ডাবল ইঞ্জিন বিমান চলাচলের জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হোক। বিমানবন্দরের জন্য ইতিমধ্যেই ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।’’
প্রসঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন
রাজ্যে সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন প্রসঙ্গের কথাও সোমবার বিধানসভায় নিজের বক্তব্যে তুলে ধরেছেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ২২টি জেলায় সংখ্যালঘু ভবন তৈরি করা হয়েছে। কেন্দ্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মৌলানা স্কলারশিপ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। ঐক্যশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপ দেয় রাজ্য সরকার। এতে ৩৫ হাজার ছাত্রছাত্রী উপকৃত হয়। সরকার এই স্কলারশিপের জন্য ১,১০০ কোটি টাকা খরচ করে। সংখ্যালঘু স্কলারশিপের বিষয়ে বাংলা শীর্ষে আছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী আরও জানান, ২৩৫টি অনুমোদনহীন মাদ্রাসাকে মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে এনেছে রাজ্য সরকার।
মমতা-শুভেন্দু বিতণ্ডা
মণিপুর নিয়ে সোমবার বিধানসভায় নিন্দাপ্রস্তাব আনে তৃণমূল। এর বিরুদ্ধে বিধানসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে মমতার সঙ্গে বাগ্যুদ্ধে জড়ালেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। নিন্দাপ্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিধানসভায় শুভেন্দু বলেন, ‘‘মণিপুরের ঘটনা সেই রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়। অন্য রাজ্য নিয়ে আলোচনা করার অধিকার নেই এই রাজ্যের। সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন বিষয় এটি। তাই এই বিষয় নিয়ে আলোচনার অধিকার নেই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে এই আলোচনা হচ্ছে।’’ শুভেন্দুর পাল্টা মমতা বলেন, ‘‘দেশের জ্বলন্ত ইস্যু।’’ সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলনেতা বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে রোজ এমন হচ্ছে।’’ প্রত্যুত্তরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘রাবিশ।’’ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা শেষ হতেই বিধানসভায় ওয়াকআউট করেন বিজেপি বিধায়কেরা। শেষে ধ্বনি ভোটে নিন্দাপ্রস্তাব পাশ হয় বিধানসভায়।
বিজেপিকে আক্রমণ মমতার
বিধানসভার অধিবেশনে বিজেপিকে আক্রমণ করেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন, ‘‘বাংলা এগোচ্ছে আপনারা (বিজেপি বিধায়ক) দেখতে পাচ্ছেন না। বেটি পড়াও বেটি জ্বালাও। বাংলাকে গালাগালি দেয়। একশোর বেশি দল পাঠিয়েছে। এ বার থেকে আমিও টিম পাঠাব। ইঁদুর-বিড়াল কামড়ালেও কমিটি আসছে। ১০০ দিনের কাজ দেবেন না। ‘ইন্ডিয়া’ ক্ষমতায় এলে সব কেসের বিচার হবে।’’ মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আবার বিঁধেছেন মমতা। বলেছেন, ‘‘সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দেওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী বিদেশে যেতে পারেন, মণিপুরে যেতে পারেন না। শান্তি এবং আলোচনার মধ্যে দিয়ে সব কিছু সম্ভব হয়। প্রধানমন্ত্রী না পারলে আমাদের দায়িত্ব দিন। আমরা শান্তি ফেরাব মণিপুরে।’’