আইএএস এবং ডব্লিউবিসিএস অফিসারদের মধ্যে ‘বৈষম্য’ দূর করার বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
শিক্ষকদের মধ্যে বেতনের বৈষম্য কেন থাকবে, সাম্প্রতিক কালে তা নিয়ে শিক্ষা শিবির থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তর হয়ে আদালতেও প্রশ্ন উঠছে। আমলাদের ক্ষেত্রে কোনও প্রশ্নের মধ্যে না-গিয়ে আইএএস এবং ডব্লিউবিসিএস অফিসারদের মধ্যে ‘বৈষম্য’ দূর করার বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানালেন, সমতা আনা হবে মর্যাদা আর অর্থ, দুই ক্ষেত্রেই। বৃহস্পতিবার ডব্লিউবিসিএস-দের বার্ষিক সাধারণ সভায় যোগ দিয়ে তাঁর বার্তা, আগামী দিনে জেলাশাসকের পদেও বিসিএস অফিসারের সংখ্যা বাড়বে। সরকারের ‘মুখ’ হিসেবে কাজ করে চলা রাজ্যের ওই সব অফিসার পাবেন বিশেষ অগ্রাধিকার। ডব্লিউবিসিএস সংগঠনের দীর্ঘ কালের দাবি মেনে এ দিন পদোন্নতি-সহ আর্থিক সুযোগ-সুবিধার ঘোষণাও করেন মমতা।
সমালোচনার সুর তুলতে দেরি করেনি বিরোধী শিবির। তাদের একাংশের বক্তব্য, তৃণমূল কংগ্রেস সরকার যে-ভাবে আমলা-নির্ভর প্রশাসন চালাতে চাইছে, তাতে আমলাতন্ত্রেরই ভারসাম্য নষ্ট হবে।
বিসিএস-দের উদ্দেশে মমতা এ দিন বলেন, “আপনারা সরকারের প্রকৃত মুখ। আপনারা আমার রাজ্যের অফিসার। কোভিডের বিরুদ্ধে আপনারা যে-ভাবে পরিবার এবং জীবনকে বাজি রেখে লড়াই করেছেন, তাতে আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা চার জন অফিসারকে হারিয়েছি।”
প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের ব্যাখ্যা, সর্বভারতীয় পেশায় কর্মরত আইএএস এবং আইপিএস অফিসারদের ক্যাডার আইন সংশোধন করতে চাইছে কেন্দ্র। শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হলে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের উপরে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ তুলনায় কিছুটা কমবে, বাড়বে কেন্দ্রের। বদলি বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রের উপরে নির্ভরতা অনেকটাই বাড়বে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের। অন্য দিকে, রাজ্যের নিজস্ব ক্যাডারের (ডব্লিউবিসিএস) অফিসারেরা রাজ্য সরকারের উপরেই নির্ভরশীল। প্রবীণ আমলাদের অনেকেরই প্রশ্ন, তবে কি ‘ভরসা’র প্রশ্নে এ ভাবেই আইএএস অফিসারদের ‘টেক্কা’ দেবেন ডব্লিউবিসিএস অফিসারেরা?
রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এক দিকে জেলা ভাগ করে বিকেন্দ্রীকরণ করতে চাইছেন আবার আমলাদের কেন্দ্রিকতার দিকে টেনে আনতে চাইছেন! দু’টো পরস্পরবিরোধী। উনি যা বলছেন, তাতে আইপিএস-ডব্লিউবিসিএস মিলিয়ে আমলাতন্ত্রের যে-ভারসাম্য আছে, সেটা নষ্ট হবে।’’
যদিও মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি দুই ক্যাডারের মধ্যেকার ‘বৈষম্য’ দূর করতে চান। কারণ, দুই স্তরের অফিসারেরাই রাজ্যের উন্নয়নের জন্য কাজ করেন। তাই পদোন্নতি, আর্থিক সুবিধার প্রশ্নে কিছুটা সমতা আনার চেষ্টা করেছে সরকার। তিনি বলেন, “ডব্লিউবিসিএস অফিসারেরা রাজ্যের অফিসার। এই মাটির। আইএএস-রা দিল্লির ক্যাডার। আইএএস-দের মধ্যে যাঁরা বেঙ্গল ক্যাডারে রয়েছেন, তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে কাজ করেন। আইএএস এবং ডব্লিউবিসিএস-দের মধ্যে যেন কোনও বৈষম্য না-হয়। আপনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে কাজ করবেন। কোনও ভেদাভেদ যেন না-থাকে।”
বিসিএস অফিসারেরা এখন পূর্ব মেদিনীপুর, বীরভূম ও পুরুলিয়ায় জেলাশাসক হিসেবে কাজ করছেন। মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে দিয়েছেন: ১) জেলার সংখ্যা বাড়লে বিসিএস ক্যাডারের অফিসারেরা আরও বেশি করে জেলাশাসক হওয়ার সুযোগ পাবেন। ২) জেলাশাসক, অতিরিক্ত জেলাশাসক, এসডিও, বিডিও-র পদে আইএএস এবং ডব্লিউবিসিএস-দের প্রাপ্য ভাতায় কোনও ফারাক থাকবে না। যেমন আইএএস জেলাশাসকেরা এখন ৩০০০ টাকা, অতিরিক্ত জেলাশাসকেরা ২৫০০ টাকা এবং এসডিও-রা পান ২০০০ টাকা। একই স্তরে ডব্লিউবিসিএস অফিসারেরা পান যথাক্রমে ১৩০০, ১২০০ এবং ১২০০ টাকা। ৩) আইএএস অফিসারদের মতো ডব্লিউবিসিএস অফিসারদের বার্ষিক স্বাস্থ্যপরীক্ষার ব্যবস্থা করবে সরকার। ৪) দু’বছর বিশেষ সচিব পদে কাজ করলে দফতরের সচিব হওয়ার সুযোগ থাকবে সিনিয়র বিসিএসদের। তবে ওই সব পদ স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে ডব্লিউবিসিএস অফিসার মহলে।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের প্রতিক্রিয়া, ‘‘সবই তেলা মাথায় তেল দেওয়ার রাজনীতি! সরকারি পদে স্থায়ী নিয়োগ বন্ধ, অবসরপ্রাপ্তদের ঠিকমতো পেনশন নেই, স্কুলেও নিয়োগ বন্ধ। আবার ডব্লিউবিসিএস অফিসারদের বলছেন, তোমাদের আরও দেব! আসলে উনি আমলা-নির্ভর প্রশাসন চালাতে চান। সাধারণ প্রশাসন এবং পুলিশের মধ্যে বশংবদ শ্রেণি তৈরি করতে চান।’’
মমতা বলেন, “আগে ডব্লিউবিসিএস থেকে খুব কম ডিএম করা হয়েছে। তিনটে জায়গায় তাঁদের ডিএম করেছি, আরও করব। অনেক দফতরে ভাল সচিব, বিশেষ সচিব খুঁজে পাওয়া যায় না। এই জায়গাগুলো আপনাদের ভরতে হবে নিজেদের পারফরম্যান্স দিয়ে। যুগ্ম, অতিরিক্ত ও বিশেষ সচিব পদের সংখ্যা ১৬৩ থেকে
৩৫০ করেছি। মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে একটা কমিটি হয়েছে, আরও ২০০ জন ডব্লিউবিসিএসের কোটা বাড়ানোর জন্য।” ডব্লিউবিসিএস সংগঠনের একাংশের বক্তব্য, এখন আট বছরে ডেপুটি সেক্রেটারি এবং ১৬ বছরে সিনিয়র ডেপুটি সেক্রেটারি হওয়া যায়। প্রত্যেকের সুবিধার্থে ১৬ বছরের সময়সীমাটা কমিয়ে ১৪ বছর করার দাবি পাশ করেছিল রাজ্য মন্ত্রিসভা। কিন্তু এ দিন তা ঘোষণা করা হয়নি।
রাজ্যের রোপা আইনের পে-১১-র আওতায় নির্দিষ্ট ঊর্ধ্বসীমার উপরে ইনক্রিমেন্ট পাওয়া যায় না। ফলে সিনিয়র পদে অনেক অফিসারের আর্থিক লোকসান হয়। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, এই সব ক্ষেত্রে প্রতি মাসে তাঁদের বিশেষ ভাতা হিসেবে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, “এটা করতে অর্থ দফতরের সঙ্গে কথা বলতে হয়। ওরা কম বলেছিল। আমি বাড়িয়ে ১০ হাজার করেছি।” অফিসারদের সততার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন মমতা।