শেষ মুহূর্তে শতাব্দী ছেড়ে সড়কপথে মমতা, জল্পনা

তিনি আসছেন। ‘ভিভিআইপি ইজ অ্যাপ্রোচিং’। পুলিশের ‘ম্যানপ্যাকে’ এই খবর আসতেই ব্যস্ততা তুঙ্গে উঠল। হাওড়ার ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মে চোখের নিমেষে ‘পজিশন’ নিল পুলিশ। শতাব্দী এক্সপ্রেসের প্রথম শ্রেণির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত চেয়ারকারে তিনি উঠবেন। তাই নাইলনের মোটা দড়ি দিয়ে জায়গাটা ঘিরে দেওয়া হল, যাতে সেখান দিয়ে মাছিও না গলতে পারে। রেলের পদস্থ অফিসারেরা তাঁকে স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে পড়েন ক্যাব রোডের সেই জায়গায়, যেখানে গাড়ি থেকে নেমে তিনি প্ল্যাটফর্মে ঢুকবেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৪৯
Share:

গাড়িতে সওয়ার মুখ্যমন্ত্রী। নবান্ন থেকে উত্তরবঙ্গের পথে। নিজস্ব চিত্র

তিনি আসছেন। ‘ভিভিআইপি ইজ অ্যাপ্রোচিং’।

Advertisement

পুলিশের ‘ম্যানপ্যাকে’ এই খবর আসতেই ব্যস্ততা তুঙ্গে উঠল। হাওড়ার ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মে চোখের নিমেষে ‘পজিশন’ নিল পুলিশ। শতাব্দী এক্সপ্রেসের প্রথম শ্রেণির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত চেয়ারকারে তিনি উঠবেন। তাই নাইলনের মোটা দড়ি দিয়ে জায়গাটা ঘিরে দেওয়া হল, যাতে সেখান দিয়ে মাছিও না গলতে পারে। রেলের পদস্থ অফিসারেরা তাঁকে স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে পড়েন ক্যাব রোডের সেই জায়গায়, যেখানে গাড়ি থেকে নেমে তিনি প্ল্যাটফর্মে ঢুকবেন।

ট্রেন ছাড়তে তখন পাঁচ মিনিট বাকি। রেল ও পুলিশ কর্তারা অস্থির পায়চারি করছেন। কোথায় তিনি?

Advertisement

খবর এল, স্টেশনে ঢোকার অল্প দূরে কনভয় ঘুরিয়ে নবান্নে ফিরে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! তা হলে কি মুখ্যমন্ত্রী ট্রেনে যাবেন না? তা যে যাবেন না, সেটা বোঝা গেল কিছু ক্ষণ পরেই। কিন্তু কেন? তা নিয়ে গোটা স্টেশন চত্বর জুড়ে জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে। রাত পর্যন্ত তার অবসান হয়নি। কী এমন কারণে একেবারে শেষ মুহূর্তে গাড়ি ঘুরিয়ে নবান্নে ফিরে তার পরে সড়কপথে অন্তত সাত ঘণ্টার পথ পেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী রায়গঞ্জে পৌঁছলেন, তা এখনও পর্যন্ত রহস্যেই ঢাকা।

কথা ছিল, সোমবার দুপুর ২টো ১০-এর শতাব্দী এক্সপ্রেসে মালদহ যাবেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই মতো গত শনিবার মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে রেলের অতিথিশালায় কলকাতা, হাওড়া ও রেল পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয় রেলকর্তাদের। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, এ দিন সকাল থেকেই কড়া নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হবে গোটা স্টেশন চত্বর। বাড়তি নিরাপত্তা থাকবে নির্দিষ্ট ওই প্ল্যাটফর্মেও।

সেই মতো এ দিন সকাল ৮টা থেকেই স্টেশনের ভিতরে, ঢোকার মুখে ও সামনের রাস্তায় প্রায় এক হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এ ছাড়াও ছিল আরপিএফের সশস্ত্র কম্যান্ডো বাহিনী, কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনী, হাওড়া সিটি পুলিশ ও রেল পুলিশের কয়েক’শ জওয়ান। আনা হয় পাঁচটি স্নিফার ডগ-ও।

বেলা তখন একটা। স্টেশনে ঢোকেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। সঙ্গে আইজি রেল এন আর রমেশবাবু-সহ রেলের পদস্থ কর্তারা। যে ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মে শতাব্দী থামবে, সেখানে গিয়ে দাঁড়ান মুকুলবাবু। এ দিনই সকালে যাত্রীশেড ভেঙে পড়া এবং আচমকা টা্যক্সি ধর্মঘট নিয়ে সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করাও শুরু করেন। “এ সব নিয়ে আমি কিছু বলব না”, বলতে বলতে স্টেশন সুপারের ঘরে চলে যান মুকুলবাবু।

ট্রেন ধরতে হাওড়া পৌঁছলেন মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী মুকুল রায়। ট্রেনে অবশ্য যাওয়া হয়নি তাঁর। নিজস্ব চিত্র

বেলা দেড়টার সময় কারশেড থেকে প্ল্যাটফর্মে এসে ঢোকে আপ শতাব্দী এক্সপ্রেস। ট্রেনে ওঠার জন্য প্ল্যাটফর্মে তখন যাত্রীদের ভিড়। যে কামরায় মুখ্যমন্ত্রী যাবেন, তাতে উঠে পড়েন মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা বিশেষ নিরাপত্তা কর্মীরা। তাঁরা তল্লাশি শেষ করার পরই সেই কামরায় অন্য যাত্রীদের উঠতে দেওয়া হয়। বেলা ২টো। খবর আসে, মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় স্টেশনের কাছাকাছি এসে পৌঁছে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী আসছেন, খবর রটতেই উল্টো দিকের ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ভিড় জমে যায় তাঁকে দেখতে। তখনই দেখা গেল, একটা পাইলট ভ্যান স্টেশনের ক্যাব রোড দিয়ে এগিয়ে আসছে। তার পিছনের গাড়িতে মুকুলবাবু। তাঁরা স্টেশন চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। ট্রেন ছাড়তে মিনিট পাঁচেক বাকি। তা হলে মুখ্যমন্ত্রী কোথায়? মুকুলবাবুই বা চলে গেলেন কেন?

এক পদস্থ পুলিশ কর্তার কাছে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী স্টেশনে ঢোকার দু’মিনিট আগে তেলকলঘাটের মোড় থেকে কনভয় ঘুরিয়ে নিয়েছেন। ফের ফিরবেন কি না, বলতে পারব না।” মুহূর্তে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে পুলিশ কর্মীদের মধ্যে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী কেন ফিরে গেলেন? রেলের এক পদস্থ পুলিশ কর্তার উত্তর, “কেন এলেন না, জানি না। কী ভাবে মালদহ যাবেন, বলতে পারব না। আমাদের কিছুই জানানো হয়নি।”

শতাব্দী এক্সপ্রেস স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে শুরু হয় নতুন জল্পনা। তা হলে কি পরে অন্য কোনও ট্রেনে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী? কিন্তু সে বিষয়টি জানতে পারেননি রেল ও পুলিশের কর্তারা। ফলে এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত স্টেশন থেকে পুলিশ কর্মীদের সরানো হয়নি। এমনকী বিকেলে মুখ্যমন্ত্রী সড়কপথে মালদহে রওনা হয়েছেন খবর আসার পরেও পুলিশ কর্মীদের ডিউটি থেকে অব্যাহতি দিতে পারেননি পদস্থ কর্তারা।

মুখ্যমন্ত্রীর যাওয়া নিয়ে প্রায় সারা দিন একই ধোঁয়াশা ছিল নবান্নেও। প্রশাসনের শীর্ষকর্তা থেকে দলের নেতা কারও কাছেই সঠিক উত্তর ছিল না। যিনি যা বলেছেন, সবই অনুমানভিত্তিক।

মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গ যাবেন, নবান্নে আসবেন না খবরটা ছিলই। তাই এ দিন পুলিশের মধ্যেও ঢিলেঢালা ভাব ছিল। কিন্তু দু’টো বাজার একটু আগে থেকে চেহারাটা বদলাতে শুরু করে। সেই সময় পুলিশের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ওয়াকিটকির মাধ্যমে কিছু কথা জানার পরেই দেখা যায়, উর্দিধারীরা সকলেই কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঢিলেঢালা ভাব উড়ে গিয়ে শুরু হল তৎপরতা। লিফটের সামনে সরকারি কর্মীদের দাঁড়াতে নিষেধ করছে পুলিশ। সাংবাদিকদেরও সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কেন? হঠাৎ কেন এই তৎপরতা? প্রশ্নের উত্তরে এক পুলিশ কর্মী ফিসফিস করে শুধু বললেন, “ভিআইপি আসছেন।” মুখ্যমন্ত্রী নেই, তা হলে কে সেই ভিআইপি? তিনি কার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন? এ নিয়ে জল্পনা শুরু হয় পুলিশ এবং সাংবাদিকদের মধ্যে।

২টো ১০ মিনিট। নিজের ছোট গাড়ি থেকে নামেন মুখ্যমন্ত্রী। সঙ্গে সচিব গৌতম সান্যাল। থমথমে মুখে হন হন করে হেঁটে লিফটে উঠে সোজা চোদ্দোতলা। একটু পরেই হাজির মুকুল রায়। মমতাকে দেখে গুঞ্জন শুরু হয়, কেন তিনি ফিরলেন নবান্নে? এই দোলাচল আর রহস্য নিয়েই পঞ্চাশ মিনিট কাটল। ৩টে নাগাদ মুকুলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে নবান্ন ছাড়লেন মমতা।

পুলিশ সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী নিজের গাড়ি দিল্লি রোডের উপর ছেড়ে দেন। সেখানে আইবি-র পাঠানো বড় গাড়িতে চেপে পানাগড় থেকে দার্জিলিঙ মোড় হয়ে উত্তরবঙ্গের পথে রওনা দেন। নবান্নের ব্যাখ্যা, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের বেহাল অবস্থা। চার লেনের রাস্তার কাজ বহু দিন আগে শুরু হলেও জমির অভাবে তা এগোচ্ছে না। তাই তুলনায় ভাল বীরভূমের রাস্তা দিয়েই মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া হয়।

যাওয়ার পথের ব্যাখ্যা না হয় মিলল। কিন্তু গাড়ি করে কেন? কখনই বা এই সিদ্ধান্ত হল? যে সব জেলা দিয়ে তাঁর কনভয় গিয়েছে, তাদেরই এক পুলিশ সুপার জানান, ‘বেলা দু’টোর আগে বার্তা আসে। জানানো হয়, মুখ্যমন্ত্রী সড়কপথে যাবেন। কিন্তু পথে কোনও অতিরিক্ত পুলিশি ব্যবস্থা রাখা যাবে না। সংশ্লিষ্ট এসপি-রা ছোট বাহিনী নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় নিজের নিজের জেলা পার করিয়ে দেবেন’।

এ দিন সকাল থেকে ট্যাক্সি না পাওয়া হয়রান যাত্রীদের ভিড় উপচে পড়েছিল হাওড়া স্টেশনে। ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন অনেকেই। সেই ভিড় দুপুর পর্যন্ত কমেনি। অনেকে মনে করছেন, ক্ষুব্ধ যাত্রীদের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা এড়াতেই শেষ মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রীর সফরসূচির এই পরিবর্তন। তবে সেই যুক্তি খণ্ডন করে বলা হচ্ছে, হাওড়া স্টেশন চত্বর এবং প্ল্যাটফর্ম এমন ভাবে পুলিশি নিরাপত্তায় মুড়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ক্ষোভের আঁচ পৌঁছনোর উপায়ই ছিল না। কারও মতে, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে হঠাৎ এমন কোনও বার্তা পৌঁছেছিল, যার জন্য তিনি নবান্নে ফেরেন। সেখানে মুকুলকে ডেকে নেন এবং নিজের ঘরে প্রায় পঞ্চাশ মিনিট থাকেন। বেরিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ যথারীতি পাননি সাংবাদিকরা।

তখনও জানতেন, হাওড়া স্টেশন হয়েই যাবেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কনভয়ের অপেক্ষায় পুলিশ ও উৎসুক যাত্রীরা। নিজস্ব চিত্র

মুখ্যমন্ত্রীর ট্রেন যাত্রা বাতিল করার কারণ হিসাবে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, কেন্দ্রে মোদী সরকার আসার পরেই মমতা তাঁর এত দিনের ‘পণ’ ভেঙে ট্রেনে উঠলে নানা রকম রাজনৈতিক ব্যাখ্যা হতো। তাই পিছিয়ে গেলেন তিনি। যদিও এই তত্ত্ব বাতিল করার মতো তথ্যও যথেষ্ট। প্রথমত, এমন সিদ্ধান্ত হঠাৎ নেওয়ার নয়। দ্বিতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর অফিসের নামে শতাব্দীতে ৩৩টি আসন সংরক্ষণ করতে বলা হয় রেলকে। এক সঙ্গে এত আসন দিতে সমস্যা হতে পারে বুঝে রেল বাড়তি প্রথম শ্রেণির চেয়ারকার বগি জুড়ে দেয়। একই ভাবে তাঁরা মালদহ থেকে ফিরবেন বলে ১৩ অগস্ট কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসেও ৩৩টি আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এখন দেখার, ফেরার পথে মুখ্যমন্ত্রী মমতা কী সিদ্ধান্ত নেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement