বিধানসভায় সংবিধান দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
সংবিধান দিবস কেন্দ্র করে রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রীর সরাসরি ‘বিরোধ’ প্রকাশ্যে চলে এল। মঙ্গলবার বিধানসভায় সংবিধান দিবস পালনের অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্য বিনিময় দূরের কথা, চোখাচোখিও কার্যত হয়নি। বরং বক্তৃতায় দু’জনেই দু’জনকে রীতিমতো খোঁচা দেন।
তৃণমূল বিধায়কদের মুখে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনতে শুনতে বিধানসভা ছাড়েন ধনখড়। যাওয়ার আগে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলে যান, ‘‘বড় বাড়াবাড়ি(এক্সেস) হচ্ছে।’’ অন্যদিকে, মমতা তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘‘অনেক রাজ্যপালের সঙ্গে কাজ করেছি। কারও সঙ্গে এমন ঝগড়া হয়নি। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? এটা গণতন্ত্রের পক্ষে ভাল নয়।’’ মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘আপনাকে (ধনখড়) কে কেন পাঠিয়েছে সব জানি।’’
তার আগে তাঁর ‘সাংবিধানিক মর্যাদা’র কথা তুলে ফের খোঁচা দিয়েছিলেন ধনখড়ও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের পদমর্যাদা লঘু করা হচ্ছে। একের পর এক ঘটনায় তা বোঝা যায়। এই ধরনের বিরূপতার প্রকাশ বেনজির।’’ ধনখড় চান, বিধানসভায় আলোচনার মাধ্যমে সদস্যরা এ বিষয়ে ‘আত্মানুসন্ধান’ করুন।
সংঘাতে ইন্ধন দিয়েই এ দিন বক্তৃতা শুরু করেছিলেন রাজ্যপাল। তাঁর প্রথম ক্ষোভ, অল্প দিনের নোটিসে বিধানসভায় সংবিধান দিবস উদ্যাপনের আমন্ত্রণ পেয়ে তা গ্রহণ করেছেন তিনি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যদের রাজভবনে এই দিবস পালনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এক মাস আগে। বস্তুত, বিধানসভার অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেই রাজ্যপাল চলে যান রাজভবনের অনুষ্ঠানে। সেখানে রাজ্যের কোনও মন্ত্রী বা শাসক দলের কোনও বিধায়ক ছিলেন না। বিরোধী বাম-কংগ্রেস ও বিজেপি বিধায়কেরা সেখানে হাজির ছিলেন। সেখানেও রাজ্যপাল বলেন, ‘‘আমাকে জিজ্ঞাসা না করে বিধানসভার অনুষ্ঠান ঠিক হয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়ে আমাকে যেতে বলা হয়েছে মাত্র। তাই আমার অতিথিদের বলতে হয়েছে যে রাজভবনের অনুষ্ঠানের সময়ের কিছু রদবদল হয়েছে।’’
যখন রাজভবনের অনুষ্ঠান চলছে, তখন বিধানসভায় বক্তৃতা করছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমাকে নেমন্তন্ন করেছেন তো এত বার প্রকাশ্যে বলার কী আছে? সকাল থেকে টুইট করে কেন বলছেন তা! আমি তো তিন বার চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, বিধানসভা চলবে। কোনও কাজে আটকে যেতেই পারি। আমি তো বিশেষ বিশেষ দিনে রাজভবনে যাই। আপনি কি সত্যিই চেয়েছেন যে আমি রাজভবনে যাই, নাকি শুধুই মানুষকে জানাতে চান যে আমায় নেমন্তন্ন করেছেন!’’
বিধানসভায় এ দিনের বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে দুপুর থেকেই হাজির ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যপাল পৌঁছন সাড়ে পাঁচটার একটু আগে। তাঁকে স্বাগত জানাতে স্পিকার, মুখ্যমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান, বাম নেতা সুজন চক্রবর্তী আগে থেকেই হাজির ছিলেন। গাড়ি থেকে রাজ্যপাল নামার পরে প্রথমেই এগিয়ে যান মান্নান ও সুজন। স্পিকার বা মুখ্যমন্ত্রীকে তখনও তাঁর দিকে এগিয়ে যেতে দেখা যায়নি। রাজ্যপালও মান্নানের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করে এগোতে থাকেন। তখন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসেন স্পিকার। মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু কিছুটা পিছনে ছিলেন। অম্বেডকরের মূর্তিতে মালা দিয়ে রাজ্যপাল যখন সভাকক্ষে ঢুকছেন, তখনও অনেকটা পিছনে মুখ্যমন্ত্রী। তাঁদের পারস্পরিক নমস্কার বিনিময় করতেও দেখা যায়নি।
বক্তৃতা শেষে রাজ্যপাল যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখনও পরিস্থিতি একই। তবে তাঁর বেরনোর পথে তৃণমূল বিধায়কদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনে রাজ্যপাল হাত তুলে তাঁদের প্রতি নমস্কার জানান। এবং তার পরেই স্পিকারকে ‘বাড়াবাড়ি’র কথাটি বলে যান।
রাজ্যপালের বক্তৃতায় অনেকটা জুড়ে ছিল সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের প্রসঙ্গ। জম্মু-কাশ্মীর এর ফলে দেশের মূল সংবিধানের সঙ্গে কী ভাবে সংযুক্ত হল, এবং সারা দেশে একই সংবিধান চালু হল, তার উল্লেখ করে ধনখড় ‘দূরদর্শী’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। স্মরণ করেন বাবাসাহেব ভীমরাও অম্বেডকর, সর্দার বল্লভভাই পটেল ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে।
পরে কাশ্মীর প্রসঙ্গে রাজ্যপালকে বিঁধে মমতা বলেন, ‘‘উনি ভুলে গেলেন, এটা বাংলা না কাশ্মীর। বাংলার কথা না বলে কাশ্মীরের কথাই বেশি বলে গেলেন।’’ রাজ্যপালের সামনে দলীয় বিধায়কদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান সম্পর্কে তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার মন্তব্য, ‘‘নিজের রাজ্যের জয়গান একশোবার গাইব। বেশ করেছি। আবার করব।’’
জেলায় অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য রাজ্য তাঁকে হেলিকপ্টার দেয়নি বলে বারবার ক্ষোভ জানিয়েছেন ধনখড়। সেই প্রসঙ্গ টেনে বিধানসভায় মমতা বলেন, ‘‘হেলিকপ্টার আমাদের নেই। জরুরি প্রয়োজনে আমাদের নিতে হয়। ওই দিন আমি উত্তর ২৪ পরগায় গিয়েছিলাম। হেলিকপ্টার ফাঁকা না থাকলে কী ভাবে পাবেন? আগের অনেক রাজ্যপালই তো হেলিকপ্টার নিয়ে ঘুরেছেন।’’ এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর কাটআউটে ছেয়ে রয়েছে বলে রাজ্যপাল প্রকাশ্যে যে মন্তব্য করেছিলেন, এ দিন তারও জবাব দিয়ে মমতার কটাক্ষ, ‘‘স্পিকারকে বলছি, দেখুন সংবিধানে একটা অধ্যায় যুক্ত করা যায় কি না, যাতে বলা থাকবে রাজভবনে কার কার কাটআউট থাকবে।’’
রাজ্যপালের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ‘তিক্ততা’ কোন স্তরে গিয়েছে, তার ইঙ্গিত দিয়ে মমতা বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীও এমন ব্যবহার করেন না! দেখা হলে হেসে কথা বলেন।’’ এর পরেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘তিক্ততা, কটূক্তি নয়, ভাল ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মানবিক কেন হব না?’’