মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অধীর চৌধুরী। —গ্রাফিক সনৎ সিংহ।
প্রায় তিন দশক চলে গিয়েছে। কিন্তু বাংলার রাজনীতি ভোলেনি আলিপুরের ট্রেজারি বিল্ডিংয়ের সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই প্রতিবাদ। তৎকালীন কংগ্রেস নেত্রী মমতা গলায় কালো শাল জড়িয়ে ‘আত্মহননের’ প্রতীকী প্রতিবাদ করেছিলেন। কিসের প্রতিবাদ? প্রতিবাদ কংগ্রেসের তৎকালীন প্রদেশ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। অধুনাপ্রয়াত সোমেন মিত্রের বিরুদ্ধে। সাল ১৯৯৬। মমতার দাবি ছিল অধীর চৌধুরী, সুলতান আহমেদ, শঙ্কর সিংহ, মৃণাল সিংহরায়কে বিধানসভায় কংগ্রেসের প্রার্থী করা চলবে না। কারণ, তাঁরা ‘সমাজবিরোধী’।
তবে অধীররা শেষ পর্যন্ত ভোটে লড়েছিলেন। ‘হাত’ চিহ্ন নিয়েই। মামলার কারণে নিজের কেন্দ্র মুর্শিদাবাদের নবগ্রামে সশরীরে ঢুকতে পারেননি অধীর। কিন্তু তা-ও বামদুর্গ ভেঙে জিতেছিলেন। বীজপুরে অবশ্য মৃণাল হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু জিতেছিলেন সুলতান এবং শঙ্কর।
কালক্রমে মৃণাল রাজনীতি থেকে হারিয়ে গিয়েছেন। সুলতান এবং শঙ্কর নাম লিখিয়েছেন মমতার দলে। তৃণমূলে যোগ দিয়ে উলুবেড়িয়ার সাংসদ হয়েছিলেন সুলতান। তিনি এখন প্রয়াত। শঙ্কর জিততে পারেননি। তবে তাঁর পুত্র জিশু নদিয়ায় গুছিয়ে তৃণমূল করেন। এমনকি, তখন যে সোমেনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে মমতা ওই চারজনের টিকিট পাওয়া নিয়ে ‘বিদ্রোহ’ করেছিলেন, সেই সোমেনও মমতার দলে নাম লিখিয়ে ডায়মন্ড হারবার থেকে সাংসদ হয়েছিলেন। পরে যদিও তিনি কংগ্রেসে ফিরে যান। সেই থেকে আমৃত্যু তিনি কংগ্রেসে ছিলেন।
কিন্তু অধীর কখনও কংগ্রেস ছাড়েননি। সেই ১৯৯৬ সালেও তিনি কংগ্রেসে ছিলেন। এই ২০২৪ সালেও তিনি সেই কংগ্রেসেই। ‘হাত’ না-ছেড়েই নির্বাচনী রাজনীতিতে অপরাজিত রয়েছেন অধীর। মমতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের উন্নতি হয়নি। বরং উত্তরোত্তর অবনতিই হয়েছে।
সেই বিরোধিতার ঐতিহ্য মেনেই ২৮ বছর আগের সেই তিক্ততা ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে আরও এক বার ফিরে এসেছে।
দু’দিন বিরতির পর রাহুল গান্ধীর ‘ন্যায় যাত্রা’ রবিবার ফের শুরু হচ্ছে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি থেকে। আগামী কয়েক দিন যে যাত্রায় রাহুলের সঙ্গে থাকবেন প্রদেশ সভাপতি অধীর। আবার রবিবারেই উত্তরবঙ্গ সফরে যাচ্ছেন মমতা। রাহুলের যাত্রা নিয়ে উত্তরবঙ্গে ‘উত্তেজনা’ বাড়ছে কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে। শনিবার কংগ্রেসের তরফে অভিযোগ করা হয়, ‘ন্যায় যাত্রা’র প্রচারে লাগানো ফ্লেক্স তৃণমূল ছিঁড়ে দিয়েছে। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে মমতাকে চিঠি লিখে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, রাহুলের যাত্রায় গোলমাল হতে পারে। তাই মমতার প্রশাসন যেন রাহুলের যাত্রাকে সুরক্ষিত রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করে। পাল্টা তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘আগে কংগ্রেস হাইকমান্ডের উচিত অধীরকে বলা যাতে তিনি মমতা ও তৃণমূল সম্পর্কে কুৎসিত আক্রমণ বন্ধ করেন। চিঠি দেওয়ার দ্বিচারিতা করে লাভ নেই।’’ ঘটনাচক্রে, রাহুলের যাত্রা অধীরের জেলা মুর্শিদাবাদে পৌঁছনোর কথা আগামী ১ ফেব্রুয়ারি। সেই রাতে মুর্শিদাবাদেই থাকবেন কংগ্রেস নেতা। আবার ঠিক তার আগের দিন অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারি মমতার প্রশাসনিক সভা রয়েছে মুর্শিদাবাদে। সেখানে কে কী বলেন, কী ঘটনা ঘটে, সে দিকেও নজর থাকবে যুযুধান দু’পক্ষের।
প্রদেশ নেতৃত্ব মনে করেন, মমতাকে আক্রমণ করা ছাড়া অধীরের উপায় নেই। কারণ, তিনি বাংলায় তৃণমূলের উত্থান কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসিয়েই। অধীর অস্তিত্বের লড়াই লড়ছেন। ফলে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি বা রাজ্য কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা হিসেবে তাঁকে তৃণমূল এবং মমতাকে আক্রমণ করতেই হবে। পক্ষান্তরে, মমতা জানেন, তাঁর রাজত্বে বহমরপুর জেগে আছে একটি দ্বীপের মতো। ‘অধীর কাঁটা’ উপড়ে ফেলতে না পারলে ‘বঙ্গবিজয়’ নিষ্কণ্টক হবে না তাঁর। মুর্শিদাবাদের অধীরের আধিপত্য শেষ করতে বারংবার চেষ্টা করেছেন মমতা। কিন্তু গত লোকসভা ভোট পর্যন্ত অধীরকে পর্যুদস্ত করা যায়নি। মমতার বিরোধিতা করতে করতেই অধীর লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা হয়েছেন। এর মধ্যে একাধিক ভোটে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হয়েছে। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট, ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের পরে ২০১১ সালে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট গড়ে সিপিএমকে উৎখাত করেছে রাজ্যের ক্ষমতা থেকে। রাজ্য মন্ত্রিসভায় গিয়েছে কংগ্রেস। যদিও সে সখ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তখন হাইকমান্ডের (সনিয়া গান্ধীর) নির্দেশ মুখ বুজে মেনে নিতে হয়েছিল অধীরকে। কারণ, সনিয়া-মমতা সম্পর্ক গভীর।
কিন্তু মমতার সঙ্গে রাহুল গান্ধীর সে সম্পর্ক নেই। ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে মমতা সর্বসমক্ষে সনিয়া-তনয়কে ‘‘আওয়ার ফেভারিট রাহুল’’ বলে সম্বোধন করলেও রাহুল-মমতা সম্পর্ক দারুণ, এটা কেউ বলবেন না। সেই সূত্রেই অধীর তাঁর মমতা-বিরোধিতার সুর চড়িয়েছেন আসন্ন লোকসভা ভোটের আগে। মাঝে কিছু দিন নীরব থাকলেও যে মুহূর্ত থেকে অধীর বুঝেছেন জোটের রাস্তা ক্রমশ জটিল হচ্ছে, সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি আবার মমতার বিরোধিতায় অনর্গল। এতটাই যে, তৃণমূল আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়েছে, বাংলায় কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের পথে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ‘কাঁটা’ একজনই— অধীররঞ্জন চৌধুরী।
১৯৯৬ সালে লোকসভা ভোটের সঙ্গেই বাংলায় বিধানসভা ভোট হয়েছিল। সেই ভোটে মুর্শিদাবাদের নবগ্রামে অধীরকে প্রার্থী করেছিল কংগ্রেস। সেই তখনই মমতা কংগ্রেসের মধ্যে ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও নবগ্রাম বিধানসভায় অধীরের জয় একপ্রকার ইতিহাস হয়ে রয়ে গিয়েছে। সেই সময়ে সিপিএম-নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন গুচ্ছ গুচ্ছ মামলা দিয়ে অধীরের নামে হুলিয়া জারি করেছিল। অধীরকে ‘আশ্রয়’ দিয়েছিলেন সোমেন। অধীরের ভোট চাওয়ার আবেদন রেকর্ড করে তা গোটা নবগ্রাম জুড়ে মাইকে প্রচার করেছিল কংগ্রেস। ১৯৭৭ সাল থেকে বামেদের ‘দুর্গ’ হয়ে ওঠা নবগ্রামে সশরীরে না ঢুকেও প্রায় ২০ হাজার ভোটে অধীর হারিয়ে দিয়েছিলেন সিপিএমের মুজফ্ফর হোসেনকে।
এ হেন অধীরকে তার তিন বছরের মধ্যে ১৯৯৯ সালে বহরমপুর লোকসভায় প্রার্থী করে কংগ্রেস। কিন্তু সেই ভোটে আর কংগ্রেসের মধ্যে মমতার বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হননি অধীরকে। কারণ, ১৯৯৭ সালেই মমতা কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে ১৯৯৮ সালে তৃণমূল তৈরি করে ফেলেন। জীবনের প্রথম লোকসভা ভোটে জিতে সাংসদ হয়ে যান অধীর। যে বহরমপুর ছিল আরএসপির এলাকা, সেখানে জিতেছিলেন অধীর। তার পর থেকে তিনি কখনও হারেননি। জিতেছেন পর পর পাঁচ বার।
বাম জমানার শেষ দিকে রাজনৈতিক কারণে কংগ্রেস-তৃণমূল কাছাকাছি আসে। অনেকেই বলেন, সিপিএমের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট ছিলেন কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের অলিখিত অনুঘটক। তাঁর সিদ্ধান্তে সিপিএম ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার পরে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছয়। কংগ্রেসের ‘স্বাভাবিক মিত্র’ হয়ে ওঠেন মমতা। ২০০৮, ২০০৯ এবং ২০১১ সালে পর পর তিনটি ভোটে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটে বাম জমানার অবসান লেখা হয়ে যায় বাংলায়। কিন্তু মমতা-অধীর সম্পর্কে কোনও উন্নতি হয়নি। অনেকেই বলেন, মমতার সরকার থেকে কংগ্রেস বেরিয়ে এসেছিল অধীরের কথাতেই। কারণ, মহাকরণের বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রথম যিনি সরকারের বিরুদ্ধে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন, তাঁর নাম মনোজ চক্রবর্তী। ‘অধীর-ঘনিষ্ঠ’ এই কংগ্রেস নেতা মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেন। সেই সূত্রেই অনেকে বলেন, তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের বাংলায় জোট ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে নেপথ্যে কাজ করেছিলেন অধীরই। যদিও এর আনুষ্ঠানিক সত্যতা কেউই স্বীকার করেননি। সেই অধীর ২০১৬ সালের ভোটে মমতাকে সরাতে বামেদের সঙ্গে জোটের পক্ষে চলে যান। কিন্তু সেই জোট মমতার কাছে পরাস্ত হয়েছিল।
এর মাঝে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে মমতা-অধীর একে অপরকে আক্রমণ করতে গিয়ে ব্যক্তিগত স্তরেও বিঁধেছেন। কখনও মমতার বক্তৃতায় উঠে এসেছে অধীরের কন্যা বা স্ত্রীর মৃত্যুর প্রসঙ্গ। কখনও অধীর মমতাকে বলেছেন, ‘‘চোরেদের রানি!’’
মমতা অধীরের জেলায় কংগ্রেসকে ভেঙেছেন। ‘অধীর-ঘনিষ্ঠ’ নেতাদের দলে নেওয়া, পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদ ‘দখল’, লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা— সর্বত্রই মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসকে ভাঙনের মুখে পড়তে হয়েছে গত ১৩ বছরে। মমতার সেই পথে হেঁটেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কয়েক মাস আগে সাগরদিঘি বিধানসভা আসনে বাম-কংগ্রেস জোটের জয়ী প্রার্থী বাইরন বিশ্বাসের হাতে তৃণমূলের পতাকা তুলে দিয়েছেন অভিষেক। গত লোকসভায় অধীরের ‘গড়’ ভাঙার দায়িত্ব ছিল শুভেন্দু অধিকারীর উপর। মুর্শিদাবাদ ও জঙ্গিপুরে প্রথম বারের জন্য জোড়াফুল ফোটাতে পেরেছিলেন শুভেন্দু। কিন্তু অধীর তাঁর বহরমপুর ধরে রেখেছিলেন। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার ফর্মুলায় একদা ‘অধীর-ঘনিষ্ঠ’ নেতা অপূর্ব সরকারকেই (ডেভিড) বহরমপুর লোকসভায় প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। ব্যবধান প্রচুর কমে গেলেও অধীর তাঁর আসন ধরে রেখেছিলেন।
আসন্ন লোকসভা ভোটেও যে মমতা-অধীর সম্পর্কের ‘ছায়া’ বহরমপুর আসনে পড়বে তা নিশ্চিত। এবং সেই ভোটে তৃণমূল যে অধীরকে হারাতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে, তা-ও নিশ্চিত। যদিও প্রকাশ্যে অধীরকে গুরুত্ব দিতে নারাজ মমতা। দলীয় বৈঠকে মমতা মুর্শিদাবাদের তৃণমূল নেতাদের স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, অধীর কোনও ‘ফ্যাক্টর’ নন। তাঁকে নিয়ে বেশি ভাবার প্রয়োজন নেই। তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী এ-ও বার্তা দিয়েছেন যে, ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়লে বহরমপুর আসনেও জিততে পারে তৃণমূল।