নিজস্ব চিত্র
জলপাইগুড়ির মাল নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের সময় বিপর্যয়ের ঘটনাকে ‘ম্যানমেড’ (মানুষের তৈরি) বলে যে দাবি করা হয়েছে, তা সঠিক নয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে যে ভাবে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তাকে ‘নিন্দনীয়’ বলে ব্যাখ্যা করে সরকারের তরফে বিবৃতি জারি করা হল। প্রশাসনের বক্তব্য, জলোচ্ছ্বাসের কোনও আগাম খবর পাওয়া সম্ভব ছিল না। তবে অত্যন্ত যত্নসহকারে বিসর্জনের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। প্রশাসন তৎপর ছিল বলেই জীবনহানি কম হয়েছে।
শুক্রবার হড়পা বানের কারণ খুঁজতে এসে তাকে ‘ম্যানমেড’ বলে দাবি করে বিজেপির প্রতিনিধি দল। মাল নদীতে ঠাকুর বিসর্জন দিতে গিয়ে আট জনের মৃত্যুর ঘটনায় প্রশাসনকে দায়ীও করে তারা। ঘটনাচক্রে, শুক্রবারই সরকারি তরফে বিবৃতি জারি করে বলা হয়েছে, ‘‘দুর্ভাগ্যবশত কোনও বিশেষ অভিসন্ধি নিয়ে কিছু শ্রেণির মানুষ একটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রশাসনকে ও জনপ্রতিনিধিদের যে ভাবে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করছে, তা নিন্দনীয়। মানুষকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, প্রশাসনের তরফে যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল না। স্থানীয় ভাবে জল ছাড়া হয়েছে এবং তৎপর থাকলে বিপর্যয় এড়ানো যেত। এগুলি সঠিক নয়।’’
প্রশাসনের তরফে যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এ কথা জানিয়ে সরকারি বিবৃতিতে লেখা হয়েছে, ‘‘প্রশাসনের তরফে যথেষ্ট যত্নসহকারে পাকাপোক্ত ভাবে বিসর্জনের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। স্থানীয় মাল প্রশাসন, পুলিশ, মাল পুরসভার প্রচেষ্টায় জীবনহানি অনেকাংশে কম করা গিয়েছে। অন্তত ৪৫০ জন মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।’’ কিন্তু কী কারণে এত বড় বিপর্যয়, তা এখনও স্পষ্ট নয় বলেই জানানো হয়েছে প্রশাসনের তরফে। বলা হয়েছে, ‘‘মাল নদী ও তার শাখাপ্রশাখা সিকিম, ভুটান ও দার্জিলিং মিলিয়ে একটি বিস্তীর্ণ এলাকা। সেই দিন উত্তরবঙ্গে কোনও অস্বাভাবিক বৃষ্টি হয়নি। সম্ভবত রাজ্যের বাইরে মাল নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকাতে বৃষ্টি হয়েছিল কি না কিংবা মেঘভাঙা বৃষ্টির কারণে এই জলোচ্ছ্বাস এসেছিল কি না, তা গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ফলে এই জলোচ্ছ্বাসের কোনও আগাম খবর পাওয়া সম্ভব ছিল না।’’
সরকারি হিসাবে জানানো হয়েছে, হড়পা বানের কারণে আট জনের মৃত্যু হয়েছে। ১৪ জন আহত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আট জন ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। বাকিরা মাল মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার মালবাজারে উপস্থিত হয় বিজেপির নয় সদস্যের প্রতিনিধি দল। সেই দলে ছিলেন রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক তথা ফালাকাটার বিজেপি বিধায়ক দীপক বর্মণ, জলপাইগুড়ির সাংসদ জয়ন্ত রায়, শিলিগুড়ির বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির বিধায়ক শিখা চট্টোপাধ্যায়, বীরপাড়া-মাদারিহাটের বিধায়ক মনোজ টিগ্গারা। প্রথমে ঘটনাস্থলে যান তাঁরা। এর পর মৃতদের বাড়িতে যান। তাঁদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে কিছু সাহায্য তুলে দেয় এই প্রতিনিধি দল। এর পর সেখান থেকে সোজা জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। সেখানে আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা। আহতদের নাম নথিভুক্ত করার পর মালবাজার থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে গোটা ঘটনার কারণ জানতে চায় বিজেপির প্রতিনিধি দল। একই সঙ্গে তদন্ত ঠিক পথে এগোচ্ছে কি না, সেই সংক্রান্ত নথি চান বিজেপি বিধায়ক ও নেতারা।
বিজেপির সাধারণ সম্পাদক তথা ফালাকাটার বিজেপি বিধায়ক দীপক বর্মণ দাবি করেন, ‘‘গোটা ঘটনা পরিকল্পিত। এক কথায় ‘ম্যান মেড ম্যাসাকার’ বা ‘ম্যান মেড ডিজ়াস্টার’ বলা যায়। আমরা গোটা ঘটনা খতিয়ে দেখে রাজ্য বিজেপিকে রিপোর্ট পেশ করব। সুকান্তবাবুর (বিজেপি রাজ্য সভাপতি) সঙ্গে কথা বলব। প্রয়োজনে যদি আইনি পথ অবলম্বন করতে হয়, সেটাও করব। তবে আগে রাজ্যকে রিপোর্ট পেশ করব।’’ শিলিগুড়ির বিধায়ক শঙ্কর ঘোষের মন্তব্য, ‘‘মহালয়ার আগেই হড়পা বানের একটি ঘটনা ঘটে গিয়েছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সেচ দফতর কি মাল নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের অনুমতি দিয়েছিল? তা না হলে কারা অনুমতি দিল? সেই বিষয়ে কি তদন্ত শুরু হয়েছে? এটা পরিকল্পনা করে সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া। এটা জেলা প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা।’’ জলপাইগুড়ির সাংসদ জয়ন্ত রায় বলেন, ‘‘যেখানে পাহাড়ের খরস্রোতা নদীতে হড়পা বান হামেশাই আসে সেখানে নদীর মাঝখানে বিসর্জন দেখতে দেওয়ার অনুমতি দিল কে?’’ তাঁর সংযুক্তি, ‘‘অবৈধ বাঁধ দিয়ে নদীর মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার ফলে এই দুর্ঘটনা হয়েছে। এর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’’
পাল্টা জবাব দিয়েছে শাসকদলও। জলপাইগুড়ি জেলার তৃণমূলের সভাপতি মহুয়া গোপের প্রতিক্রিয়া, ‘‘বিজেপি এটা নিয়ে রাজনীতি ছাড়া আর কিছু করছে না। যে দিন থেকে ঘটনা ঘটেছে সেদিন থেকে তারা যে কথা বলছে সেটা মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি করা ছাড়া আর কিছু নয়। আজ নতুন করে মাল নদীতে ভাসান হচ্ছে না। হড়পা বানে একটা দুর্ঘটনা হয়ে গিয়েছে। বিসর্জনের দিন এমন ঘটনায় বলার কোনও ভাষা নেই। কিন্তু এর পর বিজেপি বলবে হড়পা বানও তৃণমূল নিয়ে এসেছে।’’