বাড়ির নীচেই দোকান। বিকোচ্ছে এডওয়ার্ডস টনিক! — নিজস্ব চিত্র
মশা আর আমাশা। বঙ্গজীবনের অঙ্গ এই দুই আপদের দৌলতেই আজও তাঁদের লক্ষ্মী অচলা!
বর্ষার শুরুতেই যখন চনমনে হয়ে ওঠে মশা, পেট মুচড়ে জানান দেয় আমাশা, তখনই দাওয়াইয়ের বাজার চাঙ্গা হয়। কমবেশি একশো বছরের পুরনো যে সংস্থাগুলি ম্যালেরিয়া আর আমাশয়ের ওষুধ বাজি রেখে আজও লড়াই চালাচ্ছে, তাদের ব্যবসাতেও খানিক গতি আসে।
ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘রেতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে কলকেতায় আছি’। এ বঙ্গে মশার দাপট আজও অমলিন, ম্যালেরিয়াও স্বমহিমায়। ফলে বাকি বহু ওষুধ কালের গর্ভে তলিয়ে গেলেও সরকারি লাইসেন্স সমেত দেড়শো বছর ধরে বেঁচে রয়েছে বাঙালির তৈরি ‘এডওয়ার্ডস টনিক।’ এক সময়ে বাক্সের গায়ে ইংরেজিতে লেখা থাকত— ‘ফর ম্যালেরিয়া অ্যান্ড ক্রনিক ফিভার।’ পুরনো বিজ্ঞাপন দাবি করত—‘ম্যালেরিয়া ও সর্ব্বজ্বরের মহৌষধ’। সময়ের স্রোতে ‘সর্ব্বজ্বর’ মুছে গিয়ে এখন শুধু ‘ম্যালেরিয়ার টনিক’ বলেই তার বিক্রি।
ভবানীপুরের বাসিন্দা কবিরাজ জ্যোতিপ্রকাশ গুপ্তের বয়স এখন ৮৬। জানালেন, পঞ্চাশের দশকে জে বি রায় আয়ুর্বেদ হাসপাতালে কাজ করার সময় জন্ডিস বা ম্যালেরিয়ার রোগীদের জন্য প্রেসক্রিপশনে নিয়মিত ‘এডওয়ার্ডস টনিক’ লিখতেন। তখন ম্যালেরিয়ায় ‘ডি গুপ্তের পাচন’ আর ‘কুমারেশ সিরাপ’ও খুব জনপ্রিয় ছিল। সেই সব ওষুধ আর নেই। ‘এডওয়ার্ডস টনিক’ এখনও রয়েছে জেনে বর্ষীয়ান কবিরাজ চমকিত!
১৮৫৫ সাল থেকে এই ওষুধ নিজের হাতে বানিয়ে বিক্রি শুরু করেছিলেন হাওড়া শিবপুরের বটকৃষ্ণ পাল। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বটকৃষ্ণ পাল ফার্মাসিউটিক্যালস। মংপু থেকে আনা কুইনিন, গুলঞ্চ, নিম, নাটাকরঞ্জ, সোনামুখী, হীরাকশ, নিশাদলের মতো অনেক কিছু মিশিয়ে বানানো হতো তাদের টনিক। পরে দমদম বীরপাড়ায় গড়ে উঠেছিল আস্ত কারখানা। পাল পরিবারের সদস্যরাই জানালেন, এখন ৮০ নম্বর বেনিয়াটোলা লেনের ছোট্ট কারখানায় তৈরি হচ্ছে টনিক। এমনি সময় উৎপাদন আনুমানিক মাসে তিন হাজার বোতল। বিজ্ঞাপন নেই, প্রচার নেই। তবু ম্যালেরিয়ার মরসুমে সেটা হাজার পাঁচেক বোতলে দাঁড়ায়। ১০০, ২০০ আর ৩০০ মিলিলিটারের বোতলে টনিক বিক্রি হয় শোভাবাজারে পালবাড়ির নীচের দোকান থেকেই।
ক্রেতারা বেশির ভাগই উত্তর কলকাতার। অনেক বাড়িতে বংশপরম্পরায় এই ওষুধ খাওয়া হতো। ফলে মুখে-মুখেই তাঁরা এডওয়ার্ড টনিকের নাম জানেন। ক্রেতাদের আর একটা অংশ প্রধানত হিন্দিভাষী। বটকৃষ্ণ পরিবারের পঞ্চম প্রজন্ম অনিরুদ্ধ পাল, অরিন্দম পালের কথায়, ‘‘কত টাকার ওষুধ বিক্রি করতে পারলাম সেটা এখন বড় নয়। বড় কথা হল, এই টনিককে বাঁচিয়ে রেখে দেড়শো বছরের একটা ইতিহাসকে ছুঁয়ে থাকা। মশা তাতে পরোক্ষে সাহায্য করছে!’’
ব্যবসায় মশার প্রভাব মেনে নিচ্ছে বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড-এর মতো ঐতিহাসিক সংস্থাও। ১৮৯২-এ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত ভারতের প্রথম ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। ১৯০২ সালে ১৬৪ নম্বর মানিকতলা মেন রোডে সংস্থার কারখানায় পোকামাকড় নিরোধক তৈরি শুরু হয়। শতাব্দী পেরিয়েছে, সংস্থা সরকারের হাতে গিয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মশা-মাছি
মারার লম্ফমার্কা ‘ফেনিয়ল’ই প্রাচীন বাঙালি সংস্থার প্রধান জীবনরেখা। সংস্থার ডিজিএম (এইচআর এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) তপন চক্রবর্তী জানালেন, পুরনো বেশ কয়েকটি জিনিস এখনও তৈরি হচ্ছে— ক্যান্থারাইডিন, কালমেঘ, অ্যাকোয়াটাইকোটিস, অগুরু। কিন্তু বাজার ধরায় আজ পর্যন্ত ‘ফেনিয়ল’কে কেউ হারাতে পারেনি। অ্যাকোয়াটাইকোটিস যেখানে বছরে ৮-১০ কোটি টাকার বিক্রি হয়, সেখানে ৩০ কোটি টাকার বিক্রি ‘ফেনিয়লে’র। ২০১৫ সালে ১০২ কোটি টাকার বিক্রি হয়েছে সংস্থার, যার সিংহভাগই হল ‘ফেনিয়ল’। তপনবাবুই জানালেন, বর্ষায় মশার বাড়বাড়ন্ত হলে ‘ফেনিয়লে’র কাটতি দ্বিগুণ হয়। সঙ্গে দেদার বিক্রি হয় তাঁদের ব্লিচিংও। ফলে মশাকে খারাপ বলতে তাঁদের একটু বাধো-বাধো ঠেকে বই কি!
বাঙালির ওষুধ ব্যবসায় আমাশয়ের অবদানও যে কম যায় না, তা অক্ষরে-অক্ষরে মানেন ইস্ট ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড-এর কর্তারা। ১৯৩৬ সালে শুরু হয়েছিল এই বাঙালি সংস্থা। বঙ্গসন্তানদের আমাশয়ে কুপোকাত হতে দেখে ছিয়াত্তর বছর আগে তারা বাজারে আনে ‘এন্টেরোকুইনল।’ তার পর কত ওষুধ তৈরি হল সংস্থার ছাতার তলায়, কিন্তু কেউ স্পর্শ করতে পারল না সেই আমাশা-নাশককে। আমাশাও বাঙালিকে ছেড়ে যায়নি, আর লাভের অঙ্ক ছেড়ে যায়নি বাঙালি সংস্থার তৈরি এই ওষুধকে। সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর দেবর্ষি দত্তগুপ্তই জানাচ্ছিলেন, তাঁদের বার্ষিক ব্যবসার পরিমাণ প্রায় ১১৫ কোটি টাকা। এর প্রায় ৩০ শতাংশ আসে আমাশার ওষুধ বেচে। সারা ভারতে এখনও বছরে ওই ট্যাবলেটের বিক্রি প্রায় ৫২কোটি। চমকপ্রদ বই কি! বিশেষত এ বঙ্গে যখন ব্যবসা আনতে প্রশাসনের কালঘাম ছোটে, যখন শিল্প-মানচিত্রে এ রাজ্যকে দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়! পেটরোগা বাঙালি আর নাছোড় মশা জিন্দাবাদ!