Manish Shukla

দিন বদলায়, ছাতা বদলায়, তবু চলতেই থাকে মস্তান-রাজ

টিটাগড়ের বিজেপি নেতা মণীশ শুক্লের খুনের ঘটনার পর থেকে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে অন্যতম আলোচ্য সেটাই।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী ও সুপ্রকাশ মণ্ডল

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২০ ০৪:১৪
Share:

মণীশ শুক্ল।—ফাইল চিত্র।

কলেজ পাশ করে আরও দু’-দুটো পাশ দিয়েছিলেন তিনি। এমবিএ এবং এলএলবি। বাবা চিকিৎসক। ছেলের পরিচয়ও হতে পারত অন্য রকম। কিন্তু তিনি হয়ে উঠলেন এলাকার দাদা। টিটাগড়ের তামাম জনতার ‘মণীশ ভাইয়া।’

Advertisement

টিটাগড়ের বিজেপি নেতা মণীশ শুক্লের খুনের ঘটনার পর থেকে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে অন্যতম আলোচ্য সেটাই। মণীশের শিক্ষকেরা বলছেন, ‘‘কলেজ ভোটে গা জোয়ারি করে ও আসলে রাজনীতির প্যাঁচে পড়ে গেল। অত্যন্ত বিনয়ী ছেলে ছিল ও। আসলে তাবড় রাজনীতিবিদদের ‘তোল্লাই’ অল্প বয়সে ওর মাথা ঘুরিয়ে দিল। নেতারা যে ওকে ব্যবহার করছেন, সেটা যত দিনে ও বুঝল, তত দিনে আর ফেরার পথ ছিল না ওর। ক্ষমতার নেশা পেয়ে বসেছিল ওকে!’’

শুধু মণীশ নন, গত কয়েক দশকে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল এমন অসংখ্য দাদাদের দাপাদাপি দেখেছে। শিল্পাঞ্চলের প্রবীণ মানুষেরা বলছেন, এখানকার রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন অনেক পুরনো। হুগলি নদীর তীরে একের পর এক কারখানা গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে অন্যান্য ব্যবসাও। তার হাত ধরেই শুরু হয় তোলাবাজি। এক সময় পুলিশের হাত থেকে তোলাবাজদের বাঁচাতে আসরে নামেন রাজনীতিবিদেরা। বদলে ভোটের সময়ে নেতাদের বৈতরণী পার করাতে জান লড়িয়ে দেন দাদারা। এ ভাবেই চলতে থাকে যুগলবন্দি।

Advertisement

স্মরণ করা যেতে পারে, রাজনৈতিক খুনের ইতিহাসেও ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের নাম উঠে আছে অনেক কাল থেকেই। আশির দশকে সঞ্জীব-তীর্থঙ্কর হত্যা বা এই শতকের গোড়ায় বিকাশ বসুর খুন ঘিরে রাজনৈতিক জলঘোলা হয়েছে বিস্তর। আবার রাজনীতি এবং মস্তানির বিচিত্র সহাবস্থানে যুব তৃণমূল নেতা বিকাশের খুনে যাঁদের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছিল, একই দলে তাঁরা দীর্ঘদিন থেকেছেন। পরে তাঁদের কেউ কেউ দল বদলেছেন।

বস্তুত, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল এবং সংগঠিত অপরাধ-চক্রের যোগাযোগই বহু দিনের। যখন যারা ক্ষমতায় থেকেছে, রাজনীতির চেনা রসায়ন মেনে তাদেরই ছত্রচ্ছায়ায় দাদাদের দাপট চলেছে। অনেক দশক আগে এই শিল্পাঞ্চলের নৈহাটি, কাঁকিনাড়া বা টিটাগড়ের রেল ইয়ার্ডে চলত ‘ওয়াগন ব্রেকিং’। সেই কারবারের নানা ধূসর চরিত্রের সঙ্গে রাজনীতির কারবারিদের সংযোগ এই তল্লাটের মানুষ বহু দিন দেখে এসেছেন। শিল্পাঞ্চলের এই দৈনন্দিন বাস্তব থেকেই সাহিত্যিক সমরেশ বসু তাঁর লেখার উপাদান নিয়েছেন। মৃণাল সিংহ রায়ের (আবু) মতো নেতাদের উত্থানের নেপথ্যে এই ধরনের নানা কাহিনিই শোনা যায়। রাজনীতিতে মৃণালবাবুদের শিষ্য ছিলেন মুকুল রায়েরা।

আশির দশকে কয়েক বছরের জন্য ব্যারাকপুরের সাংসদ হয়েছিলেন কংগ্রেসের দেবী ঘোষাল। তাঁর আমলে এলাকায় মস্তান-রাজ প্রশ্রয় পেয়েছিল, তেমন ইতিহাস মনে করার লোক এখনও শিল্পাঞ্চলে পাওয়া যায়। পরে ব্যারাকপুরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাংসদ হয়ে আবির্ভাব সিপিএমের তড়িৎবরণ তোপদারের। হুকুম-দখল এবং গা-জোয়ারির রাজনীতি তখন প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিল। তখনও শিল্পাঞ্চল আজকের শ্মশানের চেহারা নেয়নি। সে সময়ে এমন কিছু কাণ্ড শিল্পাঞ্চলের নানা প্রান্তে ঘটেছে, যার ক্ষত এখনও মোছেনি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই মত, পরবর্তী কালে অর্জুন সিংহদের দাদাগিরিতে এলাকার মানুষ চরম অতিষ্ঠ হলেও সিপিএম যে আর এই তল্লাটে ভোটের বাক্সে ভাল ভাগ পায়নি, তার মূল কারণ তড়িৎ-যুগের থেকে যাওয়া স্মৃতিই।

রাজনীতির চাকা ঘুরে তড়িৎবাবুরা নিস্তেজ হয়েছেন, ‘সিংহ’ হয়ে উঠেছেন অর্জুনেরা। রং বদলে অর্জুন গেরুয়া হলে তাঁর বাহিনীর অনেকেই বিজেপির পতাকার নীচে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু দলবদল এখানে নিমিত্ত মাত্র! দাদাগিরির ঐতিহ্য ঢুকে বসে আছে শিল্পাঞ্চলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। দাদারাই এখানে রাজনীতির চালক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement