রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। —ফাইল চিত্র।
ছিল বাঙালি, হল বাংলা। এবং তা গাইবার আগে ভরা নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামের দর্শকদের বলা হল, রাজ্য সঙ্গীত হচ্ছে, উঠে দাঁড়ান। মঙ্গলবার কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী আসরে রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক গানের কথা পাল্টে ফেলা নিয়ে এখন সমাজমাধ্যমে ক্ষোভের আবহ। রবীন্দ্রগানের বাণী পাল্টে ফেলা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজেও কেউ কেউ প্রতিবাদ করছেন।
সে দিন তারকাখচিত অনুষ্ঠানের সময়ে অনেকেই গান-বিভ্রাটের দিকটি প্রথমে খেয়াল করেননি। পরে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিয়োয় গানটির কথা-বদল শুনে সরব হয়েছেন। রবীন্দ্রগানের কথা কেন পাল্টানো হল? উৎসবের মঞ্চে অন্যতম গায়ক তথা মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনকে ফোন করা এবং মেসেজ পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি।
১৯০৫ সালে ব্রিটিশের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের বাঁধা গানটির ইতিহাস-মূল্য স্বীকার করেই তাকে রাজ্য সঙ্গীতের স্বীকৃতি দিয়েছিল রাজ্য সরকার। তবে গানটির শেষ দু’টি স্তবকে ‘বাঙালির পণ, বাঙালির আশা’ বা ‘বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন’ অংশটিকে ‘বাংলার’ করে গাওয়ানো যায় কি না, জানতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। রবীন্দ্রগানে বদল নিয়ে অনেকের আপত্তি দেখে অবশ্য গানটি অবিকৃত রাখার কথাই বলে রাজ্য। সরকারি তরফে জানানো হয়, রবীন্দ্রগানে বদল হবে না। কিন্তু সলমন খানদের নিয়ে তারকা-খচিত অনুষ্ঠানে ঘটল উল্টোটাই। সে-দিন মুখ্যমন্ত্রীকে মাঝখানে রেখে রাজ্যের মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, রূপঙ্কর, মনোময় ভট্টাচার্য, ইমন চক্রবর্তী, অদিতি মুন্সীর গাওয়া গানে রবীন্দ্রগানের কথা পাল্টে গিয়েছে। শেষ দু’টি স্তবকে যাবতীয় ‘বাঙালির’ করে দেওয়া হয়েছে ‘বাংলার’।
সমাজমাধ্যমে অনেকেই বলছেন, রাজ্যের শাসক দল এখন সলমন খানদের সঙ্গে মমতার পা মেলানো নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহের ‘কুকথা’র প্রতিবাদে মুখর, তা ছাড়া বিজেপি বিধায়কদের একাংশের বিরুদ্ধে জাতীয় সঙ্গীত অবমাননার অভিযোগ নিয়েও চর্চা চলছে। কিন্তু রবীন্দ্রগান বিকৃতি নিয়ে কেউ কিছু বলছেন না কেন? কার নির্দেশে রবীন্দ্রনাথের পরিচিত গানের কথা পাল্টানো হল? জবাবে ইমন বা মনোময় বলছেন, “স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে গাইতে ডেকেছেন, এটা গৌরবের। আমাদের যা গাইতে হবে তার বাণী দেওয়া হয়েছিল। সেটা দেখেই গাই! তখন আর কিছু খেয়াল হয়নি।” আর রূপঙ্কর মনে করতে পারছেন না, সে-দিন কী গেয়েছিলেন। বলছেন, “কাগজে যা লেখা ছিল, সেটাই গেয়েছি!”
রবীন্দ্রগানের এই বিকৃতিতে সংস্কৃতি জগৎ বা সারস্বত সমাজের বিশিষ্টরাও হতাশ। প্রবীণ অধ্যাপক তথা অর্থনীতিবিদ সৌরীন ভট্টাচার্য বলছেন, “গানের কথা পাল্টালে তো তা রবীন্দ্রনাথের গান থাকে না!” এই রাজ্য সঙ্গীতের সাংবিধানিক গুরুত্ব বা অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর প্রশ্ন রয়েছে। আর প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত সব শুনে বলছেন, “কিছু বলার নেই! যা হচ্ছে তাতে রবীন্দ্রনাথের কিছু আসে যায় না, সরকারের কারও কিছু আসে যায় না, মনে হয় কারওরই কিছু আসে যায় না!”