আগের মতো ‘আরামে’ এখনকার শাসক দলও

আগের মতোই বর্তমান শাসক তৃণমূলও আত্মবিশ্বাসী আর কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাহায্য প্রত্যাশী বিরোধীরা। এ যেন কোনও উপন্যাস, যেখানে গল্প একই থাকে সময় গড়ানোর সঙ্গে শুধু চরিত্রেরা বদলে যায়। রামকৃষ্ণের জন্মভূমিতেও গল্পের চরিত্রেরা ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের বদলে নিয়েছেন। 

Advertisement

প্রদীপ্তকান্তি ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৯ ০৪:১৪
Share:

আরামবাগে নাকি সব সময় ‘আরামে’ই থাকে শাসক! তা সে ভোটের ব্যবধানে হোক, বা বিরোধী দলের অস্তিত্বে। জনশ্রুতি তেমনই। সন্ত্রাসের ইতিহাস বয়ে বেড়ানো আরামবাগ শাসকের সঙ্গে থাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। এ বারের লোকসভা ভোটেও সেই চেনা রাজনৈতিক ধারায় বদল নেই।

Advertisement

আগের মতোই বর্তমান শাসক তৃণমূলও আত্মবিশ্বাসী আর কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাহায্য প্রত্যাশী বিরোধীরা। এ যেন কোনও উপন্যাস, যেখানে গল্প একই থাকে সময় গড়ানোর সঙ্গে শুধু চরিত্রেরা বদলে যায়। রামকৃষ্ণের জন্মভূমিতেও গল্পের চরিত্রেরা ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের বদলে নিয়েছেন।

১৯৯৮ সালের শেষ লগ্ন থেকে ২০১১ সালের পরিবর্তনের আগে পর্যন্ত ঘরছাড়া ছিলেন তারক মণ্ডল। বর্তমানে গোঘাট-২ পঞ্চায়েত সমিতির অন্তর্গত শ্যামবাজার গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য। চড়া রোদে পাণ্ডুগ্রামে গাছের নীচে ‘আরামে’ই বসেছিলেন তিনি। ঘরছাড়া হওয়ার ভয় আর তাঁকে তাড়া করে না। ঘটনাচক্রে, যে গাছের নীচে বসে তারকবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তার কয়েক ফুট দূরে কয়েক কাঠা জমিতে অর্ধেক সম্পূর্ণ কংক্রিটের বাড়ি দাঁত খিঁচিয়ে রয়েছে। ভাগ ভাগ করে থাকা দোকানগুলির শাটার বহু দিন না-খোলায় মরচে ধরেছে। জানা গেল, এই বাড়ির মালিক এখানে আর থাকেন না। তিনি এলাকায় সিপিএম নেতা হিসেবেই পরিচিত। কয়েক বছর ধরে ঘরছাড়া রয়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে অবশ্য যোগাযোগ করা যায়নি।

Advertisement

প্রত্যাশিত ভাবে দেওয়াল লিখন, ফ্লেক্স, ব্যানার বা পতাকা ব্যবহারে বিরোধীদের কয়েক যোজন পিছনে ফেলেছে তৃণমূল। কিন্ত ভোট পর্বে দরজায় কড়া নাড়ছেন কই তৃণমূল প্রার্থী! সেই প্রশ্নের আনুষ্ঠানিক সমর্থনও মিলেছে বাসিন্দাদের বক্তব্যে, ‘‘তৃণমূলের প্রচারে সেই জোশ নেই। গয়ংগচ্ছ মনোভাব রয়েছে। ওরা জিতবে, ধরে নিয়েই হয়তো প্রচারে গা নেই।’’ অবশ্য তা মানতে নারাজ আরামবাগের তৃণমূল প্রার্থী অপরূপা পোদ্দার। সবেমাত্র বাতানল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ঘণ্টা আড়াই রোড-শো শেষ করেছেন। দুপুর বারোটায় কয়েকশো কর্মীকে পাশে নিয়ে অপরূপা বললেন, ‘‘আমরা সকলেই সারাক্ষণ মিছিল-মিটিং করছি। কোথায় খামতি!’’

আরামবাগের সঙ্গে সন্ত্রাস আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। তবে লালের বদলে সবুজ আসায় একটা পরিবর্তন ধরা পড়ছে বাসিন্দাদের চোখে। তাঁরা জানাচ্ছেন, সিপিএম জমানায় মারধর, হাত-পা ভাঙা-কাটা, গুম করাতেই সন্ত্রাস সীমাবদ্ধ ছিল না। বাক্ স্বাধীনতাতেও হস্তক্ষেপ হত অহরহ। সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হলেও রয়েছে শীতল সন্ত্রাসের ভীতি। আরামবাগে না কি ভোট হয় না! এ বারও তাই হবে? এক তৃণমূল নেতা বলছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপ্যাধ্যায় এত উন্নয়ন করছেন। তার পরেও কেন অন্য দলকে ভোট দেবেন, আমাদের তা বোঝাতে হবে! তার পর ভোট...।’’ যদিও অপরূপা বলছেন, ‘‘এ সব বাজে কথা। ভোট না-হলে আমাদের কর্মীরা কেন দিনরাত পরিশ্রম করছেন!’’

তারকেশ্বর, পুরশুড়া, আরামবাগ, খানকুল, গোঘাট, হরিপাল এবং চন্দ্রকোনা নিয়ে আরামবাগ লোকসভা। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে ‘পরিবর্তনের হাওয়া’কে উড়িয়েই দু’লক্ষের বেশি মার্জিনে জিতেছিলেন সিপিএম প্রার্থী শক্তিমোহন মালিক। তিনিই আবার ২০১৪ সালে তৃণমূলের কাছে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ ভোটে হেরে যান। ২০১৬ সালে নির্বাচনে ওই সব বিধানসভা আসনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট ঝুলিতে পুরে কংগ্রেস এবং সিপিএমের জোটপ্রার্থীকে পরাস্ত করেছিল তৃণমূল। ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে হুগলির জেলা পরিষদের বিনা প্রতিদন্দ্বিতায় ফয়সালা হওয়া আসনগুলির বেশিরভাগই আরামবাগ লোকসভার মধ্যে পড়ে।

এক সময়ে বোধহয় আরামবাগে গাছের পাতাই শুধু সবুজ ছিল। বাকি সবই ছিল ‘লাল’। সেই দলই না কী বুঝতে পারছে না আরামবাগের ভোটচিত্র। গৌরহাটির মোড়ে দাঁড়িয়ে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দাঁড়ানো দলীয় প্রার্থীকে সঙ্গে নিয়ে দলীয় মুখপত্র বিকোচ্ছিলেন জোনাল নেতা (আপাতত সিপিএমের কমিটি শব্দবন্ধ থেকে জোনাল শব্দটি বাদ পড়েছে) গণেশ অধিকারী। একদা এলাকা হাতের তালুর মতো এলাকা চিনতেন সিপিএম নেতারা, তেমনই শোনা যেত। কিন্তু ভোট সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে গণেশবাবু বললেন, ‘‘ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।’’

রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মতোই এখানেও মাটি কামড়ানোর চেষ্টা করছে গেরুয়া শিবির। দলের কোপে পড়ার ভয় রয়েছে তো! তাই প্রকাশ্যে সে সব নিয়ে সরাসরি মন্তব্য না -করলেও আড়ালে কোনও কোনও তৃণমূল নেতা বলছেন, ‘‘পরিস্থিতি বদলাচ্ছে।’’ তারই এক সহকর্মীর মন্তব্য, ‘‘প্রকাশ্যে না হলেও দু-চার জন এ দিক ও দিক বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।’’ সেই মন্তব্যকে কার্যত মান্যতা দিচ্ছেন সিপিএম প্রার্থী শক্তিমোহন মালিক। তাঁর কথায়, ‘‘কেন্দ্রের শাসক দল। তৃণমূলের বিক্ষুব্ধেরা কেউ কেউ প্রকাশ্যে বিজেপি-কে সমর্থন করছেন। আবার অনেকে দূরে থেকে বিজেপির সঙ্গে রয়েছে।’’

তবে বিজেপি বা সিপিএম-কে নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ অপরূপা। কার্যত তাচ্ছিল্যের সুরেই তিনি বলছেন, ‘‘কে দুই, কে তিন বা কে চার হবে, সে সব ওঁরা ঠিক করুন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৈনিক হিসেবে আমরা জুমলা সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছি।’’ কামারকুণ্ডু স্টেশন লাগোয়া উড়ালপুলের প্রসঙ্গকে টেনে এলাকায় উন্নয়নে পদক্ষেপের কথা জানাতে ভুললেন না অপরূপা।

তারকেশ্বরের চাউল পট্টির সামনে মিছিলে হাঁটার সময়ে দু’পাশ থেকে উড়ে আসা পদ্মের পাপড়ি সঙ্গী করে বিজেপি প্রার্থী তপন রায় বললেন, ‘‘ভাল সাড়া পাচ্ছি। তৃণমূলকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়ব না।’’ সিপিএম প্রার্থী শক্তিমোহনবাবুর কথায়, ‘‘শেষ কয়েকটি নির্বাচনে আরামবাগ ভোট হয়নি। মানুষ ভোট দিতে পারলে আমাদের ফল ভাল হবে।’’ জনা কয়েক নেতা-কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে মানুষের দ্বারে পৌঁছে ভাল সাড়া পাচ্ছেন, তেমনই দাবি সেখানকার কংগ্রেস প্রার্থী জ্যোতিকুমারী দাসের।

ভোটের প্রত্যাশায় বিরোধীরা, আর ব্যবধান নিয়ে কাটাছেঁড়াতে ব্যস্ত ‘আরামে’ থাকা তৃণমূল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement