—ফাইল চিত্র।
গোলপার্ক পঞ্চাননতলা বাস স্টপের পাশেই সরকারি আবাসন। আবাসনে ঢুকে চন্দ্রকুমার বসুর ফ্ল্যাট কোনটা জানতে চাইলে এক জন বুঝিয়ে দিলেন, ‘‘এই সোজা যাবেন। প্রথম বাঁ দিকে ঘুরবেন। তার পর একদম সোজা। দেখবেন বাড়ির তলায় পুলিশের পাহারা রয়েছে।’’
সোজা গিয়ে বাঁ দিকে ঘুরতেই নাকে এল বোঁটকা গন্ধ। পার্কের পাশেই নোংরা ফেলার ভ্যাট, তাতে ডাঁই করা জঞ্জাল। এই গরমে গন্ধ ছড়াচ্ছে সেখান থেকেই। আর একটু এগিয়ে দক্ষিণ কলকাতার বিজেপি প্রার্থী চন্দ্রকুমার বসুর ফ্ল্যাটের নীচে পাহারায় রয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান। কার কাছে যাব, কেন যাব রেজিস্টারে লেখার পরে এক যুবক উপরে নিয়ে গেলেন। ছোট্ট বসার ঘরে কিছু ক্ষণ অপেক্ষার পরে এলেন নেতাজির নাতি। বাড়িতেও কুর্তার উপরে বিজেপির উত্তরীয়। ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হারার পরে এ বার লোকসভায় বিজেপি প্রার্থী। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘‘শুনুন এটা আসলে মমতারই কেন্দ্র। শ্যাডো ক্যান্ডিডেট দাঁড়িয়েছে। হারবে।’’
ছায়ার মায়া কাটিয়ে এ বারের তৃণমূল প্রার্থী অবশ্য এই গরমে নির্বাচনী কেন্দ্রের এ মাথা ও মাথা চষে বেড়াচ্ছেন। তুমুল গরম থেকে বাঁচার জন্য তাঁর হুড খোলা জিপের সামনের আসনের কাছে লাগানো ছোট্ট ফ্যান। দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রটা কলকাতা পুরসভার চেয়ারপার্সন মালা রায়ের একেবারে নিজের হাতের তালুর মতই চেনা। এই কেন্দ্রে আরও এক বার ভোটে লড়ার অভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে। তবে সে বার কংগ্রেসের টিকিটে লড়েছিলেন। ছেলে নির্বাণও বেঙ্গালুরু থেকে অফিসের ছুটি নিয়ে চলে এসেছেন মায়ের প্রচারে থাকার জন্য।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
১৯৯১ থেকে ২০১১ টানা কুড়ি বছর মমতাই ছিলেন এই কেন্দ্রের সাংসদ। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে উপনির্বাচনে তৃণমূলের সুব্রত বক্সী জেতেন। ২০১৪ তেও সুব্রতই জেতেন। সে বার বিজেপি প্রার্থী তথাগত রায় হেরেছিলেন ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৩৩৯ ভোটে। ২০১৬ সালে এই লোকসভার আওতায় থাকা সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রেই তৃণমূল প্রার্থী জেতেন। তার মধ্যে ভবানীপুর আসনটিতে জিতেছেন খোদ মমতা। তবে ২০১৬-তে কসবা, বালিগঞ্জ, কলকাতা বন্দর, ভবানীপুর, রাসবিহারী বেহালা-পূর্ব, বেহালা-পশ্চিম— এই সাতটি বিধানসভার মোট ভোটের নিরিখে তৃণমূলের ভোট ব্যবধান কিছুটা কমে ১ লক্ষ ২৬ হাজার ৭০১ হয়েছে। তবে ওই সাত কেন্দ্রের কোথাও বিজেপি দ্বিতীয় হতে পারেনি। কিন্তু চন্দ্রবাবুর প্রত্যয় ওই ভোট এ বার মেক আপ তো হয়ে যাবেই, এর উপর আরও দেড় লক্ষ ভোটার ইভিএম-এর বোতাম পদ্ম ফুলেই টিপবেন। বলে দিলেন, ‘‘মোদী ওয়েভেই গোটা ব্যাপারটা হবে। মোদী ওয়েভ নয়। ব্যাপারটা এখন আসলে আগ্নেয়গিরির রূপ নিয়েছে।’’ গত বিধানসভা নির্বাচনে ভবানীপুর কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী ছিলেন চন্দ্রবাবু। হেরেছিলেন। সে সময় নেতাজি সেজে প্রচারও করেছিলেন। তবে এ বার আর ও পথ মাড়াচ্ছেন না। তবুও কথাবার্তায় মোদীর পাশাপাশি নেতাজির কথা তাঁর কথায় বারবার উঠে আসছে। গায়ের কুর্তার মতই শরীরে লেপ্টে রয়েছে তাঁর নেতাজি পরিবারের পরিচয়।
এক নজরে - দক্ষিণ কলকাতা
• মোট ভোটার: ১৭ লক্ষ ২৮ হাজার ২২৭
• ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে তৃণমুলের সুব্রত বক্সি ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৩৩৯ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন।
• ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের নিরিখে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রেই এগিয়ে তৃণমূল।
কংগ্রেস এ বার যাঁকে প্রার্থী করেছে, সেই মিতা চক্রবর্তী দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে খুব একটা পরিচিত নন। কিন্তু এই কেন্দ্রের প্রচারে, পোস্টারে তাঁকে ‘দক্ষিণের মিতা’ বলেই দেখানো হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে রাহুল গাঁধীর সঙ্গে পোস্টারে। বললেন, ‘‘দাঙ্গা-সন্ত্রাসে ভর করে ভোট চাইছি না। ভোট চাইছি উন্নয়নের প্রশ্নে।’’
২০১৪ সালে বামফ্রন্ট প্রার্থী ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটর সায়েন্সের শিক্ষিকা সিপিএমের নন্দিনী মুখোপাধ্যায়। ছিলেন তৃতীয় স্থানে। এ বারও তিনিই প্রার্থী। বামেদের প্রতি সাধারণ মানুষের এখনও ভরসা রয়েছে, এই প্রত্যয় নিয়ে ভোটারের দরজায় দরজায় যাচ্ছেন। ‘‘জ্যোতিবাবুর পার্টি, লাল ঝান্ডার পার্টিকে ভোট দিন।’’ এই বলে তারাতলা বেসব্রিজের মাঝে গড়াগাছা বস্তিতে দাঁড়িয়ে মে দিবসের বিকেলে নিজের বক্তব্য শেষ করলেন। তাঁর চারপাশে তখন গোল করে উৎসুক ভিড়। সার সার টালির চালের বাড়িতে এখানে যাঁরা থাকেন, তাঁরা মূলত সাফাই কর্মী। এলাকার বাসিন্দা যোগিন্দর মল্লিক জানালেন, পাকা চাকরি এখানে কারও নেই। যেমন কাজ পান, তেমনই করেন। মে দিবসের দিন তাঁদের শিক্ষা, চাকরির দাবিকে লোকসভায় পৌঁছে দিতে ভোটের আবেদন নিয়ে বামফ্রন্ট প্রার্থী ঘুরছেন। একটু এগিয়েই রেল লাইনের ধারে তেলুগু বস্তি। এখানে যাঁরা আছেন তাঁদের পিতৃপুরুষ ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের মানুষ। বহু বছর আগে চলে এসেছেন এখানে। প্রায় ৭০-৮০ ঘরের বাস। সেখানে এসে বাম প্রার্থী ভোটের আবেদন জানালেন। বললেন, ‘‘প্রচারে বেরিয়ে এটা বুঝছি মানুষের বামদের প্রতি আশা ভরসা রয়েছে।’’ মেধাবী, শিক্ষিত বাম প্রার্থীর এই প্রত্যয় তাঁর দলের সংগঠন কতটা ভোটের বাক্সে নিয়ে যেতে পারবে তা জানা যাবে ২৩ মে।
গত লোকসভা নির্বাচনে মালা লড়েছিলেন কংগ্রসের হয়ে। সিপিএমের নন্দিনী বা বিজেপির তথাগত মালার থেকে অনেক বেশি ভোটে এগিয়েছিলেন। মালা পেয়েছিলেন ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৪৫৩ ভোট। এর পর দল বদলে এসেছেন তৃণমূলে। বরাবর পুরসভা-কেন্দ্রিক রাজনীতি করে এসেছেন এ বারের তৃণমূল প্রার্থী। দলবদলের পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন কলকাতা পুরসভার চেয়ারপার্সন পদ। আর এ বার ‘মমতার সিট’-এ প্রার্থী। তবে বিরোধীরা পথসভায় অথবা ঘরে ঘরে গিয়ে ক্যাম্পেনে তৃণমূল প্রার্থীর দলবদল আর গত বার কম ভোট পাওয়া বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন। মনে করিয়ে দিচ্ছেন মাঝেরহাট ব্রিজ ভেঙে পড়া, অথবা বেহালা-পূর্বের বিধায়কের সঙ্গে হালে দলের সম্পর্কের কথা।
মালাদেবী অবশ্য এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিতে নারাজ। জানালেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৈরি প্রকল্প থেকে মানুষ স্বস্তির জীবন কাটাতে পারছে। সেই উন্নয়নে ভর করেই তৃণমূল জিতবে। অন্য কোনও প্রচার কাজে দেবে না। আর যুদ্ধ-টুদ্ধ নিয়ে প্রচার করে কাজের কাজ কিস্যু হবে না। মালার কটাক্ষ সরাসরি বিজেপি প্রার্থীর দিকে। তাঁর বক্তব্য, গত বার বিজেপি তো কিছুটা শক্তিশালী প্রার্থী দিয়েছিল। এ বার তো তা-ও নয়। বিজেপি প্রাথী অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন মোদী-আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতেই তিনি বিশ্বাসী।
শেষ বিকেলে হাজরা মোড়ের কাছে আশুতোষ কলেজ। মালার সমর্থনে কলেজের সামনে থেকে দলের ছাত্রদের মিছিল শুরু হওয়ার মুখে। এসে পড়লেন মালা। জিপে উঠতে উঠতে বললেন, ‘‘দক্ষিণ কলকাতার মানুষই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসনকে রক্ষা করবে। অন্য কোনও দলের এই আসন দখলের কোনও সম্ভাবনা নেই।’’