Lok Sabha Election 2019

‘ভোটের আগে কত বাবু মিঠি মিঠি বুলি’

দুয়ারসিনি মোড়ে, কুঁচিয়া গ্রামে বিদ্যুৎও নেই। একটু এগিয়ে সাতগুরুম নদী পেরিয়ে রাস্তার ধারে কতকগুলি ধুলোভরা বন্ধ কটেজ। ইকো-ট্যুরিজম চালুর জন্য প্রাকৃতিক ভ্রমণকেন্দ্র।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৯ ০২:১৯
Share:

বান্দোয়ানে পেট্রল ডিজেল বিক্রি। ছবি: রথীন মাহাতো।

এ দৃশ্য কাশ্মীরের রাস্তায় এবং অরুণাচল প্রদেশের গ্রামে বহু বার দেখেছি। কিন্তু জঙ্গলমহলের বান্দোয়ানে দেখব বলে ভাবিনি।

Advertisement

দুয়ারসিনি মোড়ে এক মুদির দোকান। বয়ামে বিস্কুট, লজেন্স। পাশে কতকগুলি বড় জেরিক্যান, দুটো ফানেল। কোনও জেরিক্যানে পেট্রল, কোনওটায় ডিজেল। অনেক মোটরবাইক, গাড়ি সেখান থেকেই তেল ভরছে। এই জঙ্গুলে এলাকায় কোনও পেট্রল পাম্প নেই।

দুয়ারসিনি মোড়ে, কুঁচিয়া গ্রামে বিদ্যুৎও নেই। একটু এগিয়ে সাতগুরুম নদী পেরিয়ে রাস্তার ধারে কতকগুলি ধুলোভরা বন্ধ কটেজ। ইকো-ট্যুরিজম চালুর জন্য প্রাকৃতিক ভ্রমণকেন্দ্র। বিদ্যুতের অভাবে পর্যটক আসে না। স্থানীয়রা জানালেন, এখান থেকে ১৩ কিমি দূরে ঝাড়খণ্ডের গালুডি। পর্যটকেরা সেখানে রাত্রিবাস করেন, গাড়ি নিয়ে এ দিকে ঘুরতে আসেন।

Advertisement

নেই অনেক কিছু। পচাপানি গ্রামের লোকেরা জানালেন, রেশনে চিনি প্রায়ই আসে না। বড়জোর মাসে এক-আধ বার। দু’টাকা কেজির চাল ও ৭৫০ গ্রাম আটা অবশ্য পাওয়া যায়। সেই আটার গুণমান কহতব্য নয়। চালুনিতে ছেঁকে নিলেও এক-দেড়শো গ্রাম ভুষি বেরোয়। ‘‘আমরা আবার আপনাদের, বাবুদের মতো পাতলা রুটি খাই না। মোটা রুটি লাগে। অনেক সময় আটা জলে গুলে শালপাতায় মাখিয়ে নিই, ওপরে আর একটা শালপাতা। তার পর সেটা উনুনে পুড়িয়ে পাতাগুলি ফেলে খেয়ে নিই। বেলুন-চাকি, তাওয়া ইত্যাদির ঝঞ্ঝাট থাকে না,’’ বললেন পচাপানি গ্রামের শত্রুঘ্ন মাহাতো। এই শুখা জমিতে চাষের জন্য বর্ষাই ভরসা। শত্রুঘ্নরা আগে হাইব্রিড স্বর্ণধান চাষ করতেন। ‘‘ধানটা আগে ভাল ছিল, আজকাল রোগ হয়,’’ বললেন গ্রামের জগদীশ মিশ্র। ফলে ওঁরা জমিতে কপি, বেগুন, উচ্ছে, ডিংলা (কুমড়ো), বরবটি লাগান। এখানে সপ্তাহে এক দিন হাট বসে। ফলে আনাজগুলি বেশির ভাগ সময় ঝাড়খণ্ডের ধলভূমগড়, জাদুগোড়া বাজারে বিক্রি হয়। চাষিরা সেগুলি পিকআপ ভ্যানে তুলে দেন। পাঁচ-ছয় জন মিলে একটা ভ্যান ভাড়া করেন।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

পিকআপ ভ্যান জঙ্গলমহলের এই গ্রামে আজও প্রধান পরিবহণ। গ্রামের সুপুনাথ মুর্মু বলছিলেন, ভোরবেলায় প্রত্যেক পাড়া থেকে ছেলেরা ওই ভ্যানে উঠে জামশেদপুরে কাজ করতে যান, রাত আটটা-দশটায় ফেরেন। জামশেদপুর বলতেই বাঙালি টাটা কারখানার কথা ভাবে। কিন্তু এই ছেলেরা যান ঢালাই ও ইটভাটায় মজুর হিসেবে। মেয়েরা শালপাতার থালা ও বাবুই ঘাসের দড়ি বানান। একটা বড় থালা তৈরি করতে নয়টা পাতা লাগে। সেলাই করে একশোটা থালা তৈরি করতে দুই-তিন দিন লাগে। দাম হিসেবে ৩০ থেকে ৪০ টাকা পাওয়া যায়। নারীর শ্রমের মূল্য, আবার বলি, চমৎকার!

শ্রমের মূল্য, গণতন্ত্রের মূল্য জঙ্গল-অধ্যুষিত এই গ্রামগুলিতে কোথায়ই বা আছে? অনেক গ্রামেই দেখছি বিশেষ সংস্থার টেলিফোন টাওয়ার। মারগিজামি গ্রামের মাধব তন্তুবায় বলছিলেন, ‘‘ইন্দিরা আবাসে বাড়ি দেবে বলে ছবি করে নিয়ে গেল সাত মাস আগে। এখনও কিছু পাইনি।’’ আর এক জন জানালেন, ‘‘মাঘ মাসে একশো দিনের কাজ সেরে উঠেছি। এখনও টাকা পাইনি।’’ আর এক জন আরও ক্ষুব্ধ, ‘‘জানেন তো, টিএমসি-র ছেলেরা বলে গিয়েছে, ভোট না দিলে ২ টাকা কেজির চাল আর পাবি না।’’ অজস্র ছোট ছোট স্থানীয় সংবাদ, ছোট ছোট কথা এবং ছোট ছোট ক্ষোভ। জঙ্গলমহলের এই এলাকায় মোদী না মমতা, কে জিতবেন সেটাই শেষ সত্য নয়। বরং রাজনীতিকদের উচ্চণ্ড বক্তৃতার বাইরে এই সব ছোট ছোট দুঃখ আজকাল বাসা বাঁধে জঙ্গলমহলের ঝুমুর গানে, ‘ভোটের আগে কত বাবু মিঠা মিঠা বুলি/জিতি করি কইলকাতা না দিল্লি চল্যি গেলি/হামরা বাবু বোকা মানুষ গতর খাটাই বাঁচি/বাবু চালাক ভুল্যাইঁ করি খাছে দুধের চাঁছি।’ আমরা, শহুরে লোকেরা টিভি-বিতর্কের বাইরে জনতার এই সংস্কৃতি খেয়াল রাখি না।

শহরই কি শেষ কথা? পুরুলিয়া স্টেশন থেকে সাহেব বাঁধের রাস্তায় এখন চমকে উঠতে হয়। একাধিক শপিং মল, ডাকসাইটে সব অলঙ্কারের দোকান, তিন তারা হোটেল ও মাল্টিপ্লেক্স। এখানকার জলাশয় সাহেব বাঁধে শিকারা চলছে, চার দিক রঙিন আলোয় পিছলে যাচ্ছে। স্থানীয় পরিবেশপ্রেমীরা অবশ্য বলেন, এই সব কারণে নাকি এই জলাশয়ে আজকাল আর পরিযায়ী পাখিরা আসে না। সে যাক! পুরুলিয়া দূর অস্ত, এত বড় দেশে কোথায়ই বা পরিবেশ ভোটের বিষয় হল?

কিন্তু শিক্ষা? বান্দোয়ানের গুড়পানা গ্রামে দেখেছিলাম দুই ঘরের একটি জীর্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাশে ভাঙাচোরা একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। পচাপানি গ্রামে শুনেছিলাম, সেখান থেকে তিন কিমি দূরে কুঁচিয়া গ্রামে হাই স্কুল। হণ্টন এবং সাইকেল ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু জঙ্গলমহলের এই পুরুলিয়া শহর তো শিক্ষা-মানচিত্রে উজ্জ্বল। সৈনিক স্কুল, রামকৃষ্ণ মিশন থেকে সেন্ট জেভিয়ার্স— রয়েছে অনেকই। চলে গেলাম দামদা শিমুলিয়া গ্রামে এখানকার বিদ্যাসাগর আবাসিক বালিকা বিদ্যালয়ে। বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতির উদ্যোগে ২০০৪ সালে ৪৭ জন ছাত্রীকে নিয়ে শুরু হয়েছিল এই স্কুল। এখন পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি অবধি, ৪৫০ জন ছাত্রী। তাঁদের মধ্যে ১৫ জন প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। এঁদের মা-বাবা প্রায় নিরক্ষর। স্কুলের নিয়ম, পাশের বাড়ির মেয়ে হলেও হস্টেলে থাকতে হবে। নার্সিং শেখার জন্য ভোকেশনাল স্ট্রিম রয়েছে। প্রধান শিক্ষিকা মন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, ছাত্রীরা বছর দুয়েক আগে সুব্রত কাপও জিতেছিল।

জিজ্ঞাসা করলাম, বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার মানে তো এটা বিমান বসুর স্কুল! মন্দিরা জানালেন, ‘‘হ্যাঁ। কিন্তু বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান হওয়ার পর উনি এক বারও এই স্কুলে আসেননি। বলেছেন, আমি গেলেই রাজনীতির রং লেগে যাবে।’’ জিজ্ঞাসা করলাম, এখন? মন্দিরা জানালেন, স্কুলের অনুষ্ঠানে তৃণমূল সাংসদ মৃগাঙ্ক মাহাতো থেকে শান্তিরাম মাহাতো অনেকেই আসেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘ছাত্রী ভর্তির ব্যাপারে পলিটিক্যাল চাপ থাকে না?’’ মন্দিরা হাসলেন, ‘‘সে তো নেতারা অনেক সময়েই চিঠি লিখে পাঠান। তার পরে ফোনে বলেন, বুঝতেই পারছেন, ওটা বাধ্য হয়ে লেখা। কিন্তু আপনি স্কুলের স্ট্যান্ডার্ড নামাবেন না। যদি মেয়েটিকে ভর্তি করার মতো বোঝেন, তখনই নেবেন।’’ বললাম, ‘‘এটা কি অফ দ্য রেকর্ড?’’ মন্দিরা বললেন, ‘‘না, আপনি লিখতে পারেন।’’

এত দুঃখ-দারিদ্রেও কোথায় যেন ভরসা খুঁজে পেলাম।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement