বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টি হলে ডিভিসি আবার জলাধার থেকে জল ছাড়তে পারে বলে আশঙ্কা মুখ্যমন্ত্রীর। তিনি বলেন, “কিছু দিন আগেই আমরা একটি বন্যা সামাল দিয়েছি। ডিভিসি গত কাল আবার ২৪ হাজার কিউসেক জল ছেড়েছে। ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টি হলে আবার জল ছাড়বে। বাংলা যেন ওদের জল হজম করার একটি জায়গা হয়ে গিয়েছে। তার থেকে যদি ডিভিসি ঠিক ভাবে খনন করে পলি পরিষ্কার করে, তা হলে ওরা আরও ৪ লাখ কিউসেক জল বেশি রাখতে পারে।”
পুলিশ যে এলাকাগুলি খালি করে দেওয়ার অনুরোধ করছে, সেগুলিকে মান্যতা দেওয়ার অনুরোধ মুখ্যমন্ত্রীর। সমুদ্রের কাছে ভ্রমণ থেকে এই সময় বিরত থাকার জন্যও রাজ্যবাসীকে পরামর্শ দিলেন তিনি। একই সঙ্গে মৎস্যজীবীদেরও সতর্ক করলেন সমুদ্রে না যাওয়ার জন্য।
হেল্পলাইন নম্বরে কেউ যাতে অকারণে ফোন না করেন, সেই অনুরোধও করেন মুখ্যমন্ত্রী। কেবলমাত্র সঠিক তথ্যই হেল্পলাইন নম্বরে ফোন করে জানানোর জন্য রাজ্যবাসীকে অনুরোধ মমতার। অযথা ভয় না পেয়ে সতর্ক থাকার বার্তা দেন তিনি। সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভুল তথ্য থেকে সাবধান থাকারও পরামর্শ দেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এটি মানুষের জীবন বাঁচানোর খেলা।”
কলকাতার ‘পাম্পিং সিস্টেম’ (নিকাশি ব্যবস্থা) আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। তবে জেলায় অনেক জায়গায় নির্মাণকাজের জন্য নিকাশি নালার উপরেই বালি, পাথর ফেলে রাখা হয়। যার কারণে জল নিকাশি ব্যবস্থায় সমস্যা হয়। এই বিষয়টির দিকেও নজর রাখার পরামর্শ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
সাধারণ মানুষকে গুজবে কান না দেওয়ার পরামর্শ মুখ্যমন্ত্রীর। সকলকে সতর্ক থাকার জন্যও বলেছেন তিনি। ওড়িশার উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়লেও বাংলাতেও যে তার যথেষ্ট প্রভাব পড়তে চলেছে, সে কথাও জানিয়েছেন তিনি। ‘ল্যান্ডফল’ কখন হবে, নির্দিষ্ট কোনও সময় এখনও জানা যায়নি। যে কোনও সময়ে দুর্যোগ পরিস্থিতির জন্য আধিকারিকদের প্রস্তুত থাকার বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ভোর ৪টের সময়েও যদি ‘ল্যান্ডফল’ হয়, তার জন্যও তৈরি থাকতে বলেছেন তিনি।
নবান্নে সর্ব ক্ষণের হেল্পলাইন চালু থাকবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। নবান্নের হেল্পলাইন নম্বর (০৩৩) ২২১৪৩৫২৬ এবং ১০৭০। পাশাপাশি জেলাগুলিতেও চালু করা হয়েছে হেল্পলাইন। বৃহস্পতিবার রাতে নবান্নেই থাকবেন তিনি। নবান্নে নিজের দফতর থেকেই পরিস্থিতির দিকে নজর রাখবেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতার কথায়, “মানুষের জীবন হল সবচেয়ে দামি। মানুষের জীবন রক্ষা করতে হবে। স্কুলগুলি ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই কারণেই। আমি আজ রাতে নবান্নেই থাকব। বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের সকলে কাজ করবেন।” মুখ্যমন্ত্রী জানান, তিনি নিজের দফতর থেকে সার্বিক কাজের উপর তদারকি চালাবেন। যে আধিকারিকেরা রাতে নবান্নে থাকবেন, তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, দুর্যোগের আশঙ্কা রয়েছে এমন জায়গাগুলি থেকে তিন লাখ ৫৬ হাজার ৯৪১ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে তাঁদের মধ্যে সকলে এখনও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেননি। মুখ্যমন্ত্রী জানান, এখনও পর্যন্ত ১ লাখ ৫৯ হাজার ৮৩৭ জন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে আসবেন বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। দুর্যোগ মোকাবিলায় ৮৫১টি ক্যাম্প চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন ত্রাণশিবিরগুলিতে ৮৩ হাজার ৫৮৩ জন আশ্রয় নিয়েছেন।
বর্তমানে সাগরদ্বীপ থেকে ২৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে ঘূর্ণিঝড়। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার সকালের মধ্যেই ঘূর্ণিঝড় স্থলভাগে আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা। তার আগে পরিস্থিতির দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘ডেনা’ স্থলভাগে আছড়ে পড়ার আগে বৃহস্পতিবার বিকেলে সার্বিক পরিস্থিতির কথা তুলে ধরছেন মুখ্যমন্ত্রী।
দুর্যোগ পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দফতরের সচিবদের। কোন জেলায় কাকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, তা-ও মুখ্যমন্ত্রী মঙ্গলবার জানিয়েছিলেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার দায়িত্বে মণীশ জৈন, উত্তর ২৪ পরগনার দায়িত্বে রাজেশকুমার সিংহ, হাওড়ায় রাজেশ পাণ্ডে, পশ্চিম মেদিনীপুরের সুরিন্দর গুপ্ত, হুগলিতে ওমপ্রকাশ সিংহ মিনা, পূর্ব মেদিনীপুরে পারভেজ আহমেদ সিদ্দিকি, ঝাড়গ্রামে সৌমিত্র মোহন এবং বাঁকুড়ার দায়িত্বে অবনীন্দ্র শীল।
দুর্যোগের আশঙ্কায় ইতিমধ্যে রাজ্যের ন’টি জেলায় সব স্কুল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। উত্তর ২৪ পরগনা , দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়তে পারে। তাই আগাম সতর্কতা হিসাবে ২৩ থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত রাজ্যের এই ন’টি জেলার সব স্কুলে ছুটি থাকবে বলে আগেই ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সম্ভাব্য দুর্যোগের আশঙ্কায় ইতিমধ্যে আগাম সতর্কতা নিয়েছে রাজ্য প্রশাসন। উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলিতে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। উপকূলের থানাগুলি থেকে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে ঘন ঘন মাইকে প্রচার করা হচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘ডেনা’র কারণে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী দুই জেলা— পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং সংলগ্ন জেলাগুলিতে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। প্রভাব পড়তে পারে কলকাতাতেও। আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, ‘ডেনা’র দাপটে ভেঙে পড়তে পারে গাছ এবং শুকনো ডাল। রয়েছে কুঁড়েঘর, টালির চাল প্রভৃতি উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। দমকা হাওয়ায় ক্ষতি হতে পারে কলা, পেঁপের মতো গাছের। বিস্তীর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। কাঁচা ও পাকা দু’ধরনের রাস্তাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ঘূর্ণিঝড়ে। ভারী বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়তে পারে শহরের অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা।
শক্তি বৃদ্ধি করে ক্রমশ স্থলভাগের দিকে এগিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘ডেনা’। আলিপুর আবহাওয়া দফতর বৃহস্পতিবার দুপুরেই জানিয়েছে, সাগরদ্বীপ থেকে ৩১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে ঘূর্ণিঝড়। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার সকালের মধ্যে তা আছড়ে পড়তে পারে ওড়িশার উপকূলে। ‘ল্যান্ডফল’ হতে পারে ধামারা এবং ভিতরকণিকার মধ্যবর্তী কোনও স্থানে।