ব্রিগেডের মঞ্চে মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, মহম্মদ সেলিম ছবি: ফেসবুক।
ভিড় ব্রিগেডে দাঁড়িয়ে বাম নেতা-নেত্রীরা একটি বিষয় স্পষ্ট করলেন, সুবিচার চেয়ে লড়াই শেষ নয়, বরং এই ব্রিগেডের মাঠ থেকেই শুরু হল। রবীন্দ্রসঙ্গীত, বর্তমানে রাজ্য সঙ্গীত ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ দিয়ে শুরু হয় সভা। চলেছে কড়া নজরদারি। ব্রিগেডের উপর ঘুরেছে ড্রোন। সেলিম জানান, বাংলাকে উত্তরপ্রদেশ বা মণিপুর হতে দেবেন না। তা রুখে দেখাবেন বাংলার মানুষ। সমাবেশের শেষে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করেন মিনাক্ষী। জানান, এই প্রস্তাবনা মেনে শুরু হবে বামেদের লড়াই। ‘লাল সেলাম’, ‘অভিনন্দন’ জানিয়ে এর পর শেষ হয় সমাবেশ।
শনিবার ডিওয়াইএফের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাড়িতে গিয়ে লড়াইয়ের বার্তা নিয়ে ফিরেছেন, জানালেন মিনাক্ষী। এর পরেই পাঠ করেন সেই বার্তা, যা আদতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গানের পংক্তি— ‘যেখানে ডাক পড়ে, জীবন-মরণ-ঝড়ে আমরা প্রস্তুত’। এটাই হল মূল মন্ত্র। বুদ্ধ তাঁদের জানিয়েছেন, ব্রিগেড সফল হবেই। তাঁর সুস্থতা কামনা করেন মিনাক্ষী।
সেলিম বলেন, ‘‘এ রাজ্যে বুলডোজ়ারের রাজনীতি চলবে না। বাংলাকে অসম, মণিপুর হতে দেব না। উত্তরপ্রদেশ হতে দেব না। বুলডোজ়ারের সামনে দাঁড়ায় বামপন্থী বৃন্দা কারাত। কোনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হিজাব পরে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না।’’ তিনি জানান, এই লড়াইয়ে জাতপাত, ধর্মের বিষয় নেই। তাঁর কথায়, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটে ট্রেলার দেখিয়েছি। এ বার সিনেমা দেখাতে হবে।’’
মহম্মদ সেলিম। —নিজস্ব চিত্র।
সেলিমের কথায়, ‘‘মণিপুরে বিজেপির সরকার। দিল্লিতেও। যাঁরা বলছেন, মমতাকে সরিয়ে বিজেপিকে আনতে হবে, তাঁদের বলি, বিচারপতি অমৃতা সিংহ বলেছেন, ২০১৪ সাল থেকে ভাইপোর সম্পত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। ওই সময় দিল্লিতে এসেছে বিজেপি। আসলে বিজেপি যবে থেকে এসেছে, তৃণমূলের হাত শক্ত হয়েছে। যখন চৌকিদারই চোর, তখন আর কী হবে।’’
এক জন ‘কাকু’র কণ্ঠস্বর পরীক্ষা করতে ছ’মাস সময় লাগলে পিসির কণ্ঠস্বর নিতে কত সময় লাগবে? অঙ্কের কথা মনে করিয়ে দিয়ে কটাক্ষ করলেন সেলিম। মনে করালেন নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে অভিযুক্ত সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বর পরীক্ষার বিষয়টি। তিনি আরও বলেন, ‘‘ওঁর একটাই লক্ষ্য, পরিবারকে রক্ষা করা।’’
সেলিমের কটাক্ষ, ‘‘মমতা বলেছিলেন, যোজনা পর্ষদের বৈঠকে যাই না। অথচ একটা বৈঠকের জন্য তিন দিন দিল্লি গিয়ে বসে রইলেন। ভাইপো নয়। ভেঁপো। তার চেয়ে ডেঁপো বলা ভাল। যখন সব বেঞ্চ বলল কিছু হবে না, তখন, তিনি চলে গেলেন দিল্লি। বললেন, দাদা পায়ে পড়ি রে, ভাইপোটাকে বাঁচা।’’
সেলিম বললেন, ‘‘বামপন্থা ফাঁকা আওয়াজ দেয় না। ১০০ দিনের কাজের টাকা নেই। পঞ্চায়েত ভোটে বললেন, দিল্লি থেকে নিয়ে আসব। কত খেল, কত নিল বাংলার মানুষকে দেখাতে হবে।’’ প্রধানমন্ত্রীকেও কটাক্ষ করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘সংসদে মোদী বলেছিলেন, ‘গর্ত খোঁড়ার কাজ’। ভাতা বন্ধ করার কথা বলেছিলেন।’’
সেলিম বলেন, ‘‘যাঁরা চুরি করছে, রাজ্যের মানুষ তাঁদের শাস্তি চাইছে। যৌবনকে দেখে বলছে, তোমরা পারবে। ৫৬ নয়, ৩৫৬ নয়, মুষ্টিবদ্ধ হাত আপনারা যদি আকাশের দিকে তুলে ধরেন, মাথা উঁচু করে শপথ নেন, বাংলাকে বাঁচাতে, আমাদের শিল্প, কৃষ্টি, ঘর, মা-বোনদের ইজ্জত, ঐতিহ্য, ইতিহাস রক্ষার জন্য যদি এককাট্টা হন, কোনও দিল্লি পারবে না। ’’
তাঁর আগের বক্তা মিনাক্ষী কবি নজরুলের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করতে গিয়ে জানান, তিনি একটি লাইন ভুলে গিয়েছেন। সেই সূত্র ধরেই মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘বামপন্থা দক্ষিণপন্থার ফারাক কী? (মিনাক্ষী) উত্তেজনায় নজরুলের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, ভুলে গেছি। রণক্লান্ত তো। মমতা কী বলতে পারেন ভুলে গেছি? মোদী কখনও বলতে পারেন? কোনও ফ্যাসিস্ত পারে না। বামপন্থীরা পারেন। চোরকে চোর বলতে, গুন্ডাকে গুন্ডা বলতে, সাম্প্রদায়িককে সাম্প্রদায়িক বলতে, বামপন্থা ভয় পায়নি। পাবে না। এখানে যাঁরা এসেছেন, ভয়কে জয় করে এসেছেন।’’
‘ইনসাফ যাত্রা’ শেষ হয়েছে। ইনসাফ চেয়ে রবিবার ব্রিগেডে সভা। তা বলে লড়াই শেষ হয়নি। মিনাক্ষীর কথায়, ‘‘তা কুকুর মোটা হলে বাঘ হয় না। লড়াই আসলে নীতির। এ লড়াই শেষ নয়। লড়াই শুরু।’’
মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
বিজেপিকেও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি মিনাক্ষী। নাম না করেই জানান, এরা রেল বিক্রি করছে, নদী-নালা বিক্রি করছে। এর পরেই তৃণমূলকে একহাত নিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের ঘরের টাকা, ১০০ দিনের কাজের টাকা লুট করার সাহস হত না। অনেক আশা নিয়ে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিলেন, আকাশ থেকে নেমে কোনও ‘ফরিস্তা’ আমাদের ভাল করবে। কিন্তু বেঁচে থাকতে চাইলে আসুন লড়াইয়ে।’’
মিনাক্ষী জানালেন, ছোট থেকে ব্রিগেডে আসছেন। বাবার সঙ্গে। তখন অন্য দিকে হত মঞ্চ। এর পরেই চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের কথা তুললেন তিনি। জানালেন, টিভি ক্যামেরার সামনে নিজের শরীরের সব থেকে সুন্দর অংশ চুল কেটে ফেলেছেন যে শিক্ষিকা, তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবে। মনে করালেন, সিপিএমের নিহত কর্মী আনিস খান, সুদীপ্ত গুপ্তদের কথা।
মিনাক্ষী বলে, ‘‘কারা বলে বামপন্থীরা শূন্য। ওঁরা বামেদের ভয় পান। আমাদের রাগ নেই। ভয় নেই। কিন্তু আশঙ্কা রয়েছে, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ রুচিরুজির কথা বলছে কি না!’’
মিনাক্ষী মঞ্চে উঠে বলেন, ‘‘যে মাঠে বলেছিল খেলা হবে, তার দখল নিতে এসেছি।’’ তিনি জানান, ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার পাঠ করে মাঠ ছাড়বেন। তাঁর কথায়, ‘‘গোটা রাজ্যের রাজনীতির যখন দখল নেয় বামেরা, তখন ডানদিকের অসুবিধা হয়।’’ তিনি জানান, বামপন্থীদের লড়াই একটা গলিতে নয়।
আভাস অভিযোগ করলেন, ব্রিগেডের সমাবেশে কর্মী-সমর্থকেরা যাতে যোগ দিতে না পারেন, সে কারণে বাধা দিয়েছে শাসকদল। বিভিন্ন জায়গায় আটকে দেওয়া হয়েছে বাস। বুথে তৃণমূল-বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি এ-ও অভিযোগ করেছেন, দিল্লির সঙ্গে ‘সেটিং’ রয়েছে নবান্নের। ‘নাগপুরের প্রেসক্রিপশন’-এ চলে তৃণমূল। ১০০ দিনের কাজের টাকা বন্ধ নিয়েও সরব তিনি। আভাস বলেন, ‘‘কে চোর নয়? তৃণমূল যে চোর, নতুন কথা নয়। তৃণমূল যেমন চোর, বিজেপিও তেমন চোর।’’ তিনি জানান, টাকা না পাওয়া ‘না ইনসাফি’। তার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। গরিব মানুষের পথে যত বাধা, সবই ‘না ইনসাফি’, দাবি করেছেন তিনি।
ডিওয়াইএফআইয়ের প্রাক্তন রাজ্য সাধারণ সম্পাদক আভাস রায়চৌধুরী জানান, বাংলাকে পুনর্জাগরণের লড়াই ব্রিগেডের মঞ্চ থেকেই শুরু হবে। ছ’লক্ষ শূন্যপদ পড়ে রয়েছে। বাংলার ছেলেরা কী ভাবে কাজ পাবেন? প্রশ্ন তুলেছেন আভাস। তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের যৌবনের আশাবাদকে খুন করেছেন যিনি, তিনি এখন নবান্নের ১৪তলায় রয়েছেন। ’’
ডিওয়াইএফআইয়ের সাধারণ সম্পাদক হিমঘ্নরাজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘যে দিন সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সে দিন বলেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গে বেকার যুবকদের ভবিষ্যৎ গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন যুবসমাজ তা মেনে নিয়েছেন।’’ তাঁর কটাক্ষ, ‘মিথ্যাচার’, ‘ভণ্ডামি’র মাধ্যমে রাজনৈতিক হাতেখড়ি মমতার। তৃণমূলকে ‘জালি’ দলও বলেও খোঁচা দেন তিনি। গুজরাতে দাঙ্গার প্রসঙ্গ তুলে এনে বিজেপিকেও কটাক্ষ করেছেন তিনি। জানিয়েছেন, ইনসাফের লড়াই চলবে।
সৃজন ভট্টাচার্য জানান, ২০২৩ সালে যাঁরা ভাত কেড়ে নিল, তাঁদের ২০২৪ সালে মাত দেওয়া হবে। তিনি জানান, ২০ লক্ষ মানুষকে জুড়ে নিয়েছে ‘ইনসাফ যাত্রা’। সুরকার সলিল চৌধুরীকে স্মরণ করে নিজের বক্তৃতা শেষ করেন সৃজন।