গাড়ির সারির মধ্যে দিয়েই চলল হরতাল সমর্থনে বামেদের মিছিল। মৌলালিতে সোমবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
মৌলালি থেকে মল্লিক বাজার— পথ মাত্র দেড় কিলোমিটার। সোমবার তাঁদের ডাকা হরতালের সমর্থনে এটুকু রাস্তাই হাঁটলেন সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসুরা। তাও মিছিলের এক দিকে সারি সারি দোকান খোলা, অন্য দিক দিয়ে সাঁই সাঁই ছুটে চলেছে গাড়ি! মিছিল মল্লিক বাজারে পৌঁছনোর পরে সূর্যবাবু যখন ট্র্যাফিক পুলিশের পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছেন, তখন গাড়ির হর্নের আওয়াজে শোনাই যাচ্ছে না তাঁর কথা!
এই ছবি থেকেই স্পষ্ট, নোট-কাণ্ডের প্রতিবাদে এ দিন বামেদের ডাকা হরতাল রাজ্যকে স্পর্শমাত্র করেনি। যে কারণে বিকেলে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমানবাবু আলিমুদ্দিনে সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ‘‘এ দিনের এই ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নেব। আমরা ভেবেছিলাম, মানুষ বুঝতে পারবেন। কিন্তু সেটা ভুল ছিল।’’ বিমানবাবুর আরও দাবি, ‘‘যে কর্মচারী এবং শিক্ষক বন্ধুরা এ দিন হরতালের সমর্থনে এগিয়ে এলেন না, তাঁদের বলি, আগামী দিনে অভিজ্ঞতা দিয়ে তাঁরা বুঝবেন। কয়েক দিন পরেই বেতন এবং পেনশন পাওয়া নিয়ে যে সমস্যা দেখা দেবে, তাতে সঙ্কট আরও তীব্র হবে। তখন মানুষ বুঝবেন, আমাদের এই প্রতিবাদ যথার্থ ছিল।’’
বামেরা হরতাল ডাকার পর থেকেই বিভিন্ন মহল যে ভাবে প্রতিবাদের সুর শোনা যাচ্ছিল, তাতে হরতাল সফল হওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল আগেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নোট-কাণ্ড নিয়ে আন্দোলনে নেমে বামেদের জোরের জায়গাগুলো ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছিলেন। যেমন, বিড়ি-চা-পাট-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমিকরা বামেদের বরাবরের খুঁটি। নোট-কাণ্ডে তাঁদের দুর্দশার প্রতিকারের দাবিতে আন্দোলনের হুমকি দেন মমতা। এ দিন হরতাল ব্যর্থ হচ্ছে দেখে তিনি বাম রাজনীতি ও সংস্কৃতির পরিসর দখলে আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়েন। বামেদের ভিয়েতনাম আন্দোলনের জন্ম যে এই বাংলাতেই হয়েছিল, সে কথা স্মরণ করিয়ে নোট-বাতিলের প্রতিবাদে তেমনই লড়াইতে সামিল হওয়ার জন্য আমজনতার কাছে আবেদন জানান মমতা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তাঁর এ দিনের কর্মসূচি শেষ হয় বামেদেরই গাওয়া ‘পথে এ বার নামো সাথী’ গানটি দিয়ে!
হরতালের ব্যর্থতা নিয়ে বাম নেতৃত্বকে কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘সিপিএমের বন্ধুরা, একটু রাস্তায় নামুন, একটু হাঁটুন! রাস্তায় নেমে খাটতে হয় বন্ধুরা! ঘরে বসে বসে বন্ধ? আমাকে দেখুন, আমি এখনও কর্মী থাকতে ভালবাসি, নেতা হতে নয়।’’ পাশাপাশিই, মমতা জানান, সরকারি দফতরে এ দিন ৯৮ শতাংশ কর্মী উপস্থিত ছিলেন। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষেরও কটাক্ষ, ‘‘বামেরা অভ্যাসবশত বন্ধ ডেকে ফেলেছিলেন। তবে এটাই ওঁদের শেষ হরতাল হয়ে গেল!’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘বামেদের এ দিনের হরতাল ব্যর্থ হওয়ারই ছিল। তবে তাঁরা নিশ্চয়ই এখান থেকে শিক্ষা নেবেন।’’
সিপিএম সূত্রের অবশ্য খবর, আলিমুদ্দিনের নেতারা আসলে মমতার ভরসাতেই হরতাল ডেকেছিলেন। তাঁদের আশা ছিল, নোট-কাণ্ডের প্রতিবাদে হরতালের বিরোধিতা মমতা করতে পারবেন না। কারণ, তিনিও একই বিষয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়ে দিল্লি, কলকাতা দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। শুক্রবার বিকেলে হরতাল ঘোষণার আগে এ কে গোপালন ভবনকে সেই কথাই জানিয়েছিলেন আলিমুদ্দিনের নেতারা। কিন্তু সেই হিসেব মেলেনি। হিসেব কেন মিলল না, তিরুঅনন্তপুরমে আগামী ৫ থেকে ৭ জানুয়ারি দলের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সেই প্রশ্ন উঠবে। পলিটব্যুরোর এক সদস্য এ দিন বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের হরতালের ছবি থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট। এক, রাজ্যে সংগঠনের কোমর এখনও ভাঙা। দুই, স্রেফ মমতার নীরব সমর্থনের ভরসায় হরতালে নেমেছিলেন রাজ্যের নেতারা।’’