নিদান সিপিএমে

লম্বা কথা নয়, কাজের কথা চাই কমরেড

দলের সাধারণ সম্পাদক তখন প্রকাশ কারাট। সিপিএমের অন্দরে চালু হয়েছিল রসিকতাটা। সম্পাদকের বাড়িতে কী বাজার হবে, সেটা ঠিক করার জন্যও নাকি পলিটব্যুরোর উপস্থিত সদস্যদের নিয়ে একটা বৈঠক করে নেওয়া হয়! প্রকাশ এবং তাঁর ঘরণী বৃন্দা দু’জনেই পলিটব্যুরোর সদস্য।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৩৫
Share:

দলের সাধারণ সম্পাদক তখন প্রকাশ কারাট। সিপিএমের অন্দরে চালু হয়েছিল রসিকতাটা। সম্পাদকের বাড়িতে কী বাজার হবে, সেটা ঠিক করার জন্যও নাকি পলিটব্যুরোর উপস্থিত সদস্যদের নিয়ে একটা বৈঠক করে নেওয়া হয়! প্রকাশ এবং তাঁর ঘরণী বৃন্দা দু’জনেই পলিটব্যুরোর সদস্য। দু’জনে আলোচনা করলেও সেটাকে পলিটব্যুরোর বৈঠক বলে ধরা যেতেই পারে!

Advertisement

সমাজবাদী পার্টির এক সাংসদ এক বার সিপিএমের এক কেন্দ্রীয় নেতাকে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের দল ‘নেতাজি’র (মুলায়ম সিংহ যাদব) কথায় চলে। বেশি মিটিং লাগে না। আপনাদের তো পলিটব্যুরো, কেন্দ্রীয় কমিটি কত কিছু আছে। দীর্ঘ আলোচনা করে সেখানে যে সিদ্ধান্ত হয়, তা-ও আবার ‘ঐতিহাসিক ভুল’!’’

ঘন ঘন বৈঠক নিয়ে এই ঠাট্টা-তামাশার সংস্কৃতিতে এ বার ইতি টানতে চাইছে সিপিএম।

Advertisement

লম্বা বৈঠক শুরু হল, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের অগ্রগতি নিয়ে নেতা বক্তৃতা শুরু করলেন, জাতীয় স্তরের নানা গুরুগম্ভীর বিষয় ছুঁয়ে শেষমেশ পা়ড়ার ব্যাপারে পৌঁছলেন— যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই ক্লান্তিকর পদ্ধতিতে যে কাজের কাজ কিছু হওয়ার নয়, এত দিনে বুঝতে পেরেছে কারাটের দল! আসন্ন রাজ্য প্লেনামের খসড়া রিপোর্টে তাই ডাক দেওয়া হয়েছে, কমিটি ছোট করে এবং বৈঠকের সংখ্যা কমিয়ে খোলামেলা ও কাজের (‘বিজনেস-লাইক’) কথা বলতে হবে। এখন যেমন এ কে জি ভবনের কর্মীদের ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর করার জন্যও কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী বা উপস্থিত পলিটব্যুরোয় আলোচনা করে নেওয়া হয়! এ সব অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক আলোচনায় আর কাজ নেই!

বৈঠকের ঘনঘটা থেকে বেরিয়ে সংগঠনকে চাঙ্গা করার জন্য আরও একটি দাওয়াইয়ের কথা বলা হচ্ছে প্লেনামে। বহু ক্ষেত্রেই জেলা বা রাজ্য স্তরে শ্রমিক, কৃষক বা মহিলা শাখার মতো গণসংগঠনের যিনি নেতা, তিনি দলেও নেতৃত্ব স্তরে আছেন। এক বার তিনি দলের বৈঠক করেন, তো পরের বার গণসংগঠনের। প্লেনামের খসড়া রিপোর্ট বলছে, এ ভাবে চলার ফলে না দলের উপকার হচ্ছে, না গণসংগঠনের। এর পর থেকে এক জন নেতাকে সর্বক্ষণের একটাই দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এই সূত্র কার্যকর হলে মদন ঘোষ, শ্যামল চক্রবর্তী, দীপক দাশগুপ্ত বা মিনতি ঘোষদের দল বা গণসংগঠন, যে কোনও একটায় থাকতে হবে।

নির্বাচনী বিপর্যয়ের জেরে দল যখন কোণঠাসা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনেকে দল ছেড়ে শাসক দলে যোগ দিচ্ছেন, সেই সময়ে সদ্যসমাপ্ত রাজ্য কমিটির বৈঠকেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র ক্ষুব্ধ স্বরে বলেছেন, এত মিটিং করে কী হবে? যদি মানুষের কাছেই না পৌঁছনো যায়? সূর্যবাবু রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পর ইদানীং রাজ্য কমিটির বৈঠকে মধ্যাহ্নভোজের পরে বিরতির চল তুলে দেওয়া হয়েছে। আগে দুপুরের খাওয়া সারতে কমিটির সদস্যেরা বাইরে যেতেন, কেউ কেউ বিশ্রাম নিয়ে আবার ফিরতেন। এখন আলিমুদ্দিনেই মধ্যাহ্নভোজ বা সন্ধ্যার চা-চক্রের ব্যবস্থা থাকে। যাতে দ্রুত সে সব পর্ব মিটিয়ে রাজ্য কমিটি আবার বৈঠকে ফিরতে পারে। বিমান বসু রাজ্য সম্পাদক থাকাকালীন তাঁর লম্বা ভাষণ নিয়ে রাজ্য কমিটিতেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন দু-এক জন।

প্লেনামের খসড়া রিপোর্টেও এ বার বলা হল: ‘সভার আগে বিষয়বস্তু জানানো এবং বিশেষ কিছু থাকলে সভার আগেই লিখিত ভাবে তা পেশ করার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। বেশি সময় নিয়ে একঘেয়ে, বিরক্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য পেশ করার অভ্যাস পরিহার করতে নেতৃত্ব স্তরেই নজির তৈরি করতে হবে। প্রাণবন্ত আলোচনায় সবাইকে অংশ নিতে উৎসাহিত করতে হবে’। আগে ‘হোমওয়ার্ক’ করে আসতে হবে। যাতে বৈঠকে অন্তহীন আলোচনা করতে না হয়। নিয়মরক্ষার জন্য শুধু বৈঠক চালিয়ে গিয়ে কার্যকরী ফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে মেনে নেওয়া হয়েছে রিপোর্টে। নিচুস্তর থেকে সমালোচনা শোনার অভ্যাস যাতে আরও বেশি করে আয়ত্ত করা হয়, স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে সে কথাও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement