মহম্মদ সেলিম এবং অধীর চৌধুরী। —ফাইল চিত্র।
ধূপগড়ির ভোট রাজ্যের বিরোধী রাজনীতির পরিসরকে কী শিক্ষা দিয়ে গেল? গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে বিভিন্ন উপনির্বাচন হয়েছে। লোকসভা ভোটের আগে ধূপগড়িই আপাতত রাজ্যে সাম্প্রতিকতম বিধানসভা উপনির্বাচন। সেই ভোট এবং তার আগের ভোটগুলির নিরিখে বিরোধী বাম এবং কংগ্রেস কোথায় দাঁড়িয়ে?
গত ২৮ মাসে পাঁচটি ভোট হয়েছে রাজ্যে। সেই ভোটে শূন্য থেকে শুরু করেছিল বাম এবং কংগ্রেস। পাঁচটি ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণবঙ্গে যতটা গতি নিয়ে লড়াইতে ফিরতে পারছে তারা, উত্তরবঙ্গে তার এক আনাও নেই। দক্ষিণে বাম-কংগ্রেসের ভোটবৃদ্ধি যদি ‘বন্দে ভারত’-এর মতো হয়, তা হলে উত্তরে তাদের গতি কচ্ছপের চেয়েও কম। গঙ্গার ও পারে কার্যত স্থবিরতায় পৌঁছেছে তারা। মনে রাখতে হবে, গঙ্গার দুই পার মুর্শিদাবাদ এবং মালদহেই এখন কংগ্রেস সে অর্থে ‘জীবিত’। উত্তরবঙ্গ জুড়ে একদা কংগ্রেসের যে শক্তি ছিল, তা দিনে দিনে ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে। যেমন ক্ষয় হয়েছে সিপিএমেরও। তাদের জায়গায় উঠে এসেছে বিজেপি। ফলে উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে বিজেপিরই।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাম এবংকংগ্রেস শূন্য হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর এই প্রথম! তার পর থেকে রাজ্যে পাঁচটি বিধানসভায় উপনির্বাচন হয়েছে। তিনটি দক্ষিণবঙ্গে। দু’টি উত্তরবঙ্গে। সেই ভোটের ফলাফল দেখলে সাদা-কালোয় স্পষ্ট, উত্তরে বাম-কংগ্রেস এখন একেবারেই প্রান্তিক শক্তি। কিন্তু দক্ষিণে তৃণমূলের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার লড়াইয়ে বিজেপিকে ঠেলে সরিয়ে তারা প্রধান বিরোধী হয়ে উঠতে পেরেছে।
গত বিধানসভা ভোটে কোচবিহারের দিনহাটা থেকে জিতেছিলেন বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক। তার আগে ২০১৯ সালে লোকসভায় জিতে তিনি সাংসদ হয়েছিলেন। বিধানসভায় নিশীথ মাত্র ৫৭ ভোটে জিতলেও দলের নির্দেশে তিনি বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেন। সেই পদত্যাগের ফলে যে উপনির্বাচন হয়, সেখানে বিজেপি নিশীথের আসন ধরে রাখতে পারেনি। নিশীথের কাছে বিধানসভা ভোটে পরাজিত উদয়ন গুহকেই ফের প্রার্থী করে জিতিয়ে আনে তৃণমূল। তা-ও আবার ১ লক্ষ ৬৪ হাজার ভোটে। জেতা-হারার সেই পরিসংখ্যানের পাশাপাশিই যে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় দেখা গিয়েছিল, তা হল— ২০২১ সালে বাম-কংগ্রেস জোটের হয়ে দিনহাটায় লড়েছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের আবদুর রউফ। তিনি পেয়েছিলেন ৬,০৬৯টি ভোট। দিনহাটায় উপনির্বাচনেও সেই রউফকেই প্রার্থী করে বামেরা। তিনি সে বার পান ৬,২৯০টি ভোট। অর্থাৎ দিনহাটায় বামপ্রার্থীর ভোট বেড়েছিল ২২১টি।
ওই একই সময়ে দক্ষিণবঙ্গের নদিয়ার শান্তিপুরেও উপনির্বাচন হয়। সেখানে বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন রানাঘাটের সাংসদ জগন্নাথ সরকার। তিনিও দলের নির্দেশে বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। উপনির্বাচনে শান্তিপুর বিজেপির হাত থেকে তৃণমূল ছিনিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বদল ঘটেছিল বামেদের ভোটবাক্সে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী হিসাবে লড়েছিলেন কংগ্রেসের আইনজীবী নেতা ঋজু ঘোষাল। সুবক্তা, সৌম্যদর্শন ঋজু পেয়েছিলেন ৯,৮৪৮ ভোট। উপনির্বাচনে জোট ছিল না। বাম ও কংগ্রেস আলাদা ভাবে প্রার্থী দিয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, সিপিএমের তরুণ নেতা সৌমেন মাহাতো ৩৯,৯৫৮টি ভোট পেয়েছেন। কংগ্রেসের রাজু পাল পৃথক ভাবে লড়ে পেয়েছেন ২,৮৭৭টি ভোট। সেই অঙ্ক নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল।
তার পরে দক্ষিণবঙ্গে আরও দুটি বিধানসভায় উপনির্বাচন হয়েছে। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর কারণে বালিগঞ্জে এবং সুব্রত সাহার মৃত্যুর কারণে সাগরগিঘিতে। বালিগঞ্জে ২০২১ সালের বিধানসভায় সিপিএমের চিকিৎসক নেতা ফুয়াদ হালিম পেয়েছিলেন ৮,৪৭৪টি ভোট। উপনির্বাচনে ফুয়াদের স্ত্রী শায়রা হালিমকে দাঁড় করায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। অভিনেতা নাসিরউদ্দিন শাহের ভাইঝি সেই ভোট বাড়িয়ে নিয়ে যান ৩০,৯৭১টিতে। সাগরগিঘিতে বাম-সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে বাইরন বিশ্বাসের জয় রাজ্য রাজনীতিতে কার্যত মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। ৫০ হাজারের হার টপকে বাইরন জিতেছিলেন ২৩ হাজার ভোটে। সাগরগিঘির মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত আসনে তৃণমূলের নাস্তানাবুদ হয়ে হার নানা জল্পনার জন্ম দিয়েছিল। যদিও তিন মাসের মধ্যে বাইরনের তৃণমূলে শামিল হওয়া সে সব কিছুই স্তিমিত করে দেয়।
কিন্তু ধূপগুড়ি উপনির্বাচন ফের একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, উত্তরবঙ্গে বাম-কংগ্রেস কোনও শক্তিই নয়। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে এই ধূপগুড়িতে সিপিএম পেয়েছিল ১৩,১০৭ ভোট। এ বারের উপনির্বাচনে তারা পেয়েছে ১৩,৭৫৮ ভোট। অর্থাৎ আড়াই বছরের মধ্যে সিপিএম ৬৫১টি ভোট বাড়াতে পেরেছে। খানিকটা দিনহাটার মতোই।
কেন দুই বঙ্গে দুই ছবি?
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘উত্তরবঙ্গে তৃণমূল এবং বিজেপির ‘বাইনারি’ ভেঙে ফেলার মতো জোর আমাদের নেই। সে জোর আগামী দিনে হওয়ার সম্ভাবনাও দেখছি না।’’ অর্থাৎ তিনি মেনেই নিচ্ছেন, উত্তরবঙ্গে সংগঠন অত্যন্ত দুর্বল। কোনও কিছু দিয়েই রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদল করার জায়গায় তাঁরা নেই। উত্তরবঙ্গের একটি জেলার সম্পাদক আবার ঘরোয়া আলোচনায় অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, আদিবাসী, রাজবংশী ইত্যাদি জাতিগত সমীকরণে তৃণমূল এবং বিজেপি অনেক এগিয়ে। পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতিকে তারা যে ভাবে ব্যবহার করছে, সিপিএম সেটা পারছে না। সরাসরি তা হয়তো করা যাবে না। কিন্তু কৌশলেও করা যাচ্ছে না। ওই নেতার এমনও বক্তব্য যে, রাজনীতির অভিমুখ ঘুরে গিয়েছে। যা তাঁদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অনেকের মতে, শুধু সিপিএম নয়। কংগ্রেসের কাছেও উত্তরবঙ্গ ক্রমশ ‘কঠিন’ হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই উত্তরবঙ্গের ‘ভূমিপুত্র’ হিসাবে প্রয়াত বরকত গনিখান চৌধুরী ও প্রিয়র়ঞ্জন দাশমুন্সি নিজেদের জেলায় কংগ্রেসের ‘গড়’ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সেই উত্তরেই কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ এখন বড়সড় প্রশ্নের মুখে। ধূপগুড়ির ফলাফলের পরে প্রদেশ কংগ্রেসের এক নেতার আক্ষেপ, ‘‘উত্তরবঙ্গের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় তবু আমাদের কিছু আশার আলো এখনও রয়েছে। কিন্তু বাকি জায়গায় সংগঠন বলে কিছু নেই। ভোট কি হাওয়ায়-হাওয়ায় হবে!’’