রাজবংশী ভোট কি কমল বিজেপির? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
রাজবংশী ভোটের অঙ্ক মিলল না বিজেপির। ফলে নিজেদের ‘শক্ত ঘাঁটি’ উত্তরবঙ্গে একটি আসন হারাল তারা। পক্ষান্তরে, উত্তরে ‘রাজনৈতিক লাভ’ হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ২০২১ সালের পর থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও উপনির্বাচনেই জিততে পারেনি বিজেপি। দক্ষিণবঙ্গের শান্তিপুরের পর উত্তরের দিনহাটা হেরেছিল তারা। এবার উত্তরবঙ্গেরই ধুপগুড়ি হারাল বিজেপি। তৃতীয় জেতা আসনে হার।
ধূপগুড়ি বিধানসভা এলাকায় মোট ভোটারের ৪৬ শতাংশ রাজবংশী। বিজেপি বরাবর দাবি করে, রাজবংশী ভোট গেরুয়া শিবিরের ‘সম্পদ’। কিন্তু সেই সম্পদ আদৌ অটুট আছে কিনা, সেই প্রশ্ন তুলে দিল ধূপগুড়ি উপনির্বাচনের ফল।
গত বিধানসভা নির্বাচনে যত ভোটে জিতেছিল বিজেপি, আড়াই বছরের ব্যবধানে প্রায় সেই ব্যবধানেই তারা হারল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতেছিল ৪,৩৫৫ ভোটে। ২০২৩ সালের উপনির্বাচনে হার ৪,৩০৯ ভোটে।
তৃণমূল-বিজেপি-তৃণমূল। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মূলত রাজবংশী ভোটের উপর ‘ভরসা’ করেই ধুপগুড়ির অঙ্ক কষেছিল বিজেপি। তারা মনে করেছিল, রাজবংশী নেতা অনন্ত রায়কে (অনন্ত মহারাজ) রাজ্যসভার সাংসদ করা তাদের পক্ষে যাবে। কিন্তু দেখা গেল, সেই অঙ্কও কাজে লাগেনি। ফলাফল ঘোষণার পর অনন্ত বলেছেন, ‘‘পর্যালোচনা করতে হবে।’’ কিন্তু একইসঙ্গে বিজেপির ‘অস্বস্তি’ বাড়িয়ে দেওয়ার মতো মন্তব্যও করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আসলে রাজবংশী সমাজের মনোভাব বুঝতে হবে। তাঁদের চাহিদা না মিটলে রাজবংশী সমর্থন পাওয়া যাবে না।’’ যদিও বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার শুক্রবারের ফল দেখে রাজবংশী ভোট ‘হাতছাড়া’ বলে মানতে রাজি নন। তিনি বলেন, ‘‘একটা উপনির্বাচনের ফল দেখে এমন সিদ্ধান্তে যাওয়া ঠিক হবে না। সাধারণ ভাবেই উপনির্বাচনের ফল শাসকের দিকে আগে থেকেই হেলে থাকে। কারণ, এই নির্বাচনের ফল সরকারে বদল আনতে পারে না। আরও একটা বিষয় হল, অন্যান্য উপনির্বাচনের মতো এখানেও কম ভোট পড়েছে। তাতেই এমন ফল হয়েছে।’’
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জয়ন্ত রায় জলপাইগুড়ি আসনে ১,৮৪,০০৪ ভোটে জিতেছিলেন। ধূপগুড়ি বিধানসভাতেও ১৭,৭৬৬ ভোটে এগিয়ে ছিল তারা। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জেতে ৪,৩৫৫ ভোটে। ব্যবধান কমেছিল। এ বার ভোট আরও কমে আসনই বেদখল হয়ে গেল তাদের। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোটপ্রাপ্তির হারে অনেক অদলবদল হয়। যদিও পঞ্চায়েত নির্বাচনের সঙ্গে বিধানসভা আসনের ভোটের তুলনা ঠিক নয়। কারণ, একটি ভোট রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অধীনে হয়। অন্যটি পরিচালনা করে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। গত মঙ্গলবারের ভোটে কোনও অশান্তির অভিযোগও ছিল না ধূপগুড়িতে। ফলে এই ফল নিয়ে চিন্তায় থাকতে হবে বিজেপিকে।
বিজেপি যদিও মনে করছে, উপনির্বাচনে বিরোধী ভোট বামেদের ঝুলিতে কিছুটা কম গেলেই এমন ফল হত না। তৃণমূল পেয়েছে ৯৭,৬১৩ ভোট। বিজেপি পেয়েছে ৯৩,৩০৪ ভোট। ব্যবধান ৪,৩০৯ ভোট। সিপিএম ভোট পেয়েছে ১৩,৭৫৮।
প্রচারের মধ্যেই বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন দীপেন প্রামানিক। — ফাইল চিত্র।
তবে বামদের ভোট নিয়ে চিন্তিত নয় বিজেপি। দলের প্রাথমিক হিসাব, রাজ্যে মানুষ যে ‘বিকল্প’ হিসাবে বিজেপিকেই দেখছে, তা এই ফলাফলে প্রমাণিত। বামেদের ভোটপ্রাপ্তি প্রায় একই রয়েছে। ভোটের হার বেড়েছে মোট প্রদত্ত ভোট কম হওয়ায়। আবার ফলাফল বলছে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে যে অতিরিক্ত শাসক-বিরোধী ভোট বাম-কংগ্রেস জোট পেয়েছিল, তা বিজেপিতে ফিরে এসেছে।
কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে বিজেপির কাছে সবচেয়ে বেশি চিন্তার রাজবংশী ভোটারদের সমর্থন পুরোপুরি না পাওয়া। ধূপগুড়িতে সব রাজনৈতিক দলই রাজবংশী নির্ভর। তা এই আসনের ইতিহাস থেকে স্পষ্ট। মূল লড়াই তিন দলের হলেও অন্যান্য দল ও নির্দল মিলিয়ে এই উপনির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন সাত জন। সকলেই রাজবংশী। ছ’জন ‘রায়’ এবং এক জন ‘বর্মণ’ পদবিধারী। ২০২১ সালে বিজেপির হয়ে জিতেছিলেন রাজবংশী সমাজেরই বিষ্ণুপদ রায়। তাঁর মৃত্যুতেই এ বার উপনির্বাচন। এই উপনির্বাচনেও তৃণমূল রাজবংশী সম্প্রদায়ের নির্মলচন্দ্র রায়, বিজেপি তাপসী রায় এবং সিপিএম ঈশ্বরচন্দ্র রায়কে প্রার্থী করে। ভোটের রায় গেল তৃণমূলের ‘রায়’-এর পক্ষে।
১৯৭৭ সাল থেকেই বিধানসভায় রাজবংশী প্রতিনিধি পাঠিয়েছে জলপাইগুড়ি জেলার এই আসন। রাজবংশী ভোট নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা বিজেপি শুরু করে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকে। অল্প হলেও সাফল্য মিলেছিল। ধূপগুড়ি পুরসভাতেও চারটি ওয়ার্ডে জয় পেয়েছিল তারা। গত লোকসভা নির্বাচনে রাজবংশী ভোটের সবটাই বিজেপির পক্ষে এসেছে বলে দাবি করা হয়েছিল। সব চেয়ে বেশি রাজবংশীর বাস যেখানে, সেই কোচবিহারে বিপুল ভোটে জেতেন নিশীথ প্রামাণিক। পরে কোচবিহারের দিনহাটা বিধানসভা আসন থেকেও তিনি জিতেছিলেন ২০২১ সালে। তবে মাত্র ৫৭ ভোটের ব্যবধানে। তিনি সেই আসন ছেড়ে দেওয়ায় কয়েক মাসের ব্যবধানে সেই দিনহাটা বিজেপি তৃণমূলের কাছে হারে দেড় লক্ষেরও বেশি ভোটে। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, এত কম সময়ের মধ্যে রাজবংশী ভোট এতটা সরে গেল কী করে? সেই প্রশ্ন ফের তুলে দিল ধূপগুড়ি।
প্রচারের শেষ দিনে বিজেপিতে যোগ দেন ধূপগুড়ির প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক মিতালি রায়। — ফাইল চিত্র।
দিনহাটার পর রাজবংশী ভোটব্যাঙ্ক মেরামতে উদ্যোগী হয় বিজেপি। কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী করা হয় ‘রাজবংশী’ নিশীথকে। বাংলা থেকে প্রথম বার রাজ্যসভায় সদস্য পাঠানোর সুযোগেই রাজবংশী সমাজের ‘মহারাজা’ বলে নিজের পরিচয় দেওয়া অনন্ত রায়কে সাংসদ করে বিজেপি। তার পরেও বিজেপি যে রাজবংশী মন ছুঁতে ব্যর্থ, তা-ও কি বুঝিয়ে দিল ধূপগুড়ি? সাংসদ অনন্ত বলছেন, ‘‘রাজবংশীরা চান পৃথক রাজ্য। এটা আমার চাওয়া নয়। জনতা জনার্দনের চাওয়া। সেটা বুঝতে হবে বিজেপিকে। এ নিয়ে স্থানীয় নেতাদের ধারণায় খামতি রয়েছে। আমি তো আর রাজ্যসভায় যাওয়ার জন্য লালায়িত ছিলাম না।’’
ধূপগুড়ির ফল আরও কয়েকটি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। তৃতীয় বার রাজ্যে সরকার গঠনের পরে তৃণমূল প্রথম হেরেছিল সাগরদিঘিতে। সেই ফলাফল পর্যালোচনা করে যে কয়েকটি কারণ দেখা গিয়েছিল, তাতে সংখ্যালঘু ভোট নিয়ে প্রশ্ন ছিল। কিন্তু ধূপগুড়ির ফলাফল বলছে, তৃতীয় স্থানে থাকা বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী সংখ্যালঘু ভোটারদের সমর্থন পাননি। ওই ভোট তৃণমূলের দিকেই গিয়েছে।
বছর ঘুরলেই লোকসভা নির্বাচন। তার আগে ‘গেরুয়া গড়’ হিসাবে পরিচিত উত্তরবঙ্গে জেতা আসন হারানো বিজেপিকে উদ্বেগে রাখা উচিত। উত্তরেই এমন ফল হলে তুলনায় ‘দুর্বল’ দক্ষিণবঙ্গে কী করবে বিজেপি?