সিঙ্গাপুরে এসেও জমি প্রশ্নের মুখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দেশের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, সিঙ্গাপুরের লগ্নিকারীরা পশ্চিমবঙ্গে গেলে শিল্প স্থাপনের জন্য জমি পাওয়া যাবে তো? প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে মমতা নিজেই এই খবর জানিয়ে বলেন, “আমি ওঁকে বলেছি, জমি পেতে কোনও সমস্যা হবে না। শিল্পতালুক এবং তথ্যপ্রযুক্তি পার্কগুলিতে হাজার হাজার একর জমি ফাঁকা পড়ে রয়েছে।” রাজ্যের ল্যান্ড ব্যাঙ্ক সম্পর্কেও প্রধানমন্ত্রীকে তিনি অবহিত করেছেন বলে জানান মমতা।
পরে সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী বলেন, “সিঙ্গাপুরের কোনও সংস্থা রাজ্যে বিনিয়োগ করতে গেলে জমি কোনও সমস্যা হবে না। প্রধানমন্ত্রীকে সে কথা তথ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে।” তাঁর দাবি, ২৩টি শিল্পতালুক এবং ১৩টি তথ্যপ্রযুক্তি পার্কে রাজ্যের হাতে ৭ থেকে ১০ হাজার একর জমি রয়েছে। তার মধ্যে ৪ হাজার একর জমিতে পরিকাঠামোও তৈরি। বাকি অংশে পরিকাঠামো তৈরির কাজ চলছে।
রাজ্যের হাতে থাকা জমিতে শিল্পস্থাপনের ডাক অবশ্য এর আগে বহু বারই দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কিন্তু তাতে সে ভাবে সাড়া মেলেনি। তার মূল কারণ, ভারী শিল্পের জন্য এক লপ্তে যে জমি দরকার, তা এই ল্যান্ড ব্যাঙ্ক বা শিল্পতালুকগুলিতে নেই। আর রাজ্যে ভারী শিল্প নেই বলে, ছোট ও মাঝারি শিল্পও তেমন গড়ে উঠছে না। এ দিন অবশ্য পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড়ে রাজ্যের হাতে থাকা ১০০০ একর জমি প্রয়োজনে সিঙ্গাপুরের লগ্নিকারীদের দেওয়া যাবে বলে এ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছেন মমতা।
অন্ডালের বিমাননগরীর জমি সমস্যা নিয়েও এ দিন খোঁজখবর নিয়েছেন লি সিয়েন লুং। এই প্রকল্পে সিঙ্গাপুর সরকারি সংস্থা চাঙ্গি ইন্টারন্যাশনাল বিনিয়োগ করেছে। প্রধানমন্ত্রী মমতার কাছে জানতে চান, রানওয়ে তৈরি নিয়ে জটিলতা কাটছে না কেন? মমতার কথায়, “প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, আমি নিজে বসে আলোচনার মাধ্যমে রানওয়ের সমস্যা মিটিয়ে দিয়েছি। তাতে তিনি খুশি হয়েছেন।”
সরকারি সূত্রের খবর, যেখানে ওই রানওয়ে হওয়ার কথা, সেখানে বেশ কিছু বিদ্যুতের খুঁটি ছিল। সেগুলি সরিয়ে নতুন করে পোঁতার জন্য অল্প জমি দরকার। কিন্তু সেই জমিও নেওয়া যাচ্ছিল না। মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সবার সঙ্গে আলোচনায় বসে বর্ধমান জেলা প্রশাসন নীতিগত ভাবে জমির সমস্যা দূর করেছে। কিন্তু চাঙ্গি সূত্রে বলা হচ্ছে, জমির সমস্যা এখনও মেটেনি। ফলে রানওয়ের কাজ শেষ করা যাচ্ছে না।
পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে সবিস্তার খোঁজখবর নিয়েই যে প্রধানমন্ত্রী মমতার সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন, তা এ দিন বারবার বোঝা গিয়েছে বলে জানাচ্ছেন বৈঠকে উপস্থিত সরকারি কর্তাদের অনেকে। রাজ্যের ক্ষুদ্রশিল্পের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান প্রধানমন্ত্রী। জানতে চান শ্রম সমস্যা নিয়েও। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে জানান, ক্ষুদ্র শিল্পে রাজ্য প্রথম স্থান অর্জন করেছে। আর রাজ্যে কোথাও শ্রম-সমস্যা নেই। তিন বছর আগে বছরে ৭৮ লক্ষ শ্রম-দিবস নষ্ট হতো, এ বছর এক দিনও হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এ কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী জানতে চান, এটা কী ভাবে সম্ভব হল? মমতার কথায়, “আমি ওঁকে বলেছি, আপনারা যেমন হার্ডওয়ার্ক করে সিঙ্গাপুর বানিয়েছেন, আমরাও সে ভাবে হার্ডওয়ার্ক করে এই পরিস্থিতি তৈরি করেছি।”
সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর এ দিনের বৈঠককে ‘সুপার্ব, পজিটিভ এবং প্লাস-প্লাস-প্লাস’ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সিঙ্গাপুর সরকারের সঙ্গে সখ্য গড়তে কূটনৈতিক স্তরে একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। তার মধ্যে রয়েছে, ১৮ মাসের মধ্যে ভারত-সিঙ্গাপুর বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব। মমতা লি সিয়েন লুং-কে বলেছেন, “আপনি রাজ্যে এসে বাণিজ্যকেন্দ্রের সূচনা করে যান।” বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বাবা তথা সিঙ্গাপুরের স্রষ্টা ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কোয়ান ইউ-এর নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চেয়ার তৈরিরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গাপুর সফরের প্রথম দু’দিনে রাজ্যের প্রাপ্তি কী? অর্থমন্ত্রী জানান, সিঙ্গাপুরের অন্যতম সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংস্থা জিআইসি-র সঙ্গে বৈঠক হয়েছে রাজ্যের প্রতিনিধিদের। পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারা ঋণ বা মূলধনী তহবিল জোগাতে আগ্রহী। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগম তাদের হয়ে মধ্যস্থতা করবে বলে ঠিক হয়েছে। কলকাতায় ন্যাসকমের যে ইনকিউবেশন সেন্টার তৈরি হবে, টিসিএস-সিঙ্গাপুর তাতে সহযোগিতা করতে রাজি। এখানকার সরকারি সংস্থা সিঙ্গাপুর-আরবান (এশিয়া) বা সুরবানা রাজ্যের নগর পরিকল্পনা ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের কাজে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাতে ফেসবুক অ্যাকাউন্টে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, “কাল একটা বড় দিন। শিল্প সম্মেলনে ২০০-র বেশি প্রতিনিধি যোগ দেবেন।” এই সম্মেলন থেকে বড়সড় প্রাপ্তির আশায় রাজ্য সরকারের কর্তারা।
প্রথম বিদেশ সফরের দেশ হিসেবে সিঙ্গাপুরকে কেন বাছলেন, এই প্রশ্নের উত্তরে মমতা বলেন, “আসিয়ান দেশগুলির অর্থনৈতিক রাজধানী সিঙ্গাপুর। এখানকার অনেক সংস্থা ইউরোপ, আমেরিকায় লগ্নি করে। ‘লুক ইস্ট’ নীতিকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গে লগ্নির গন্তব্য হিসেবে তাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।” এর পর লগ্নির খোঁজে কোথায় যাবেন? মুখ্যমন্ত্রী জানান, চিন, জাপান, আমেরিকা, ব্রিটেন থেকে তাঁর কাছে আমন্ত্রণ আছে। তবে কোথায় যাবেন, তা এখনও ঠিক করেননি তিনি।
এ দিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর আর কোনও কর্মসূচি ছিল না। তাঁর সফরসঙ্গী আমলারা সিঙ্গাপুর বন্দর দেখতে গেলেও মমতা আগ্রহ দেখাননি। মুখ্যমন্ত্রী গত কাল জুরং পাখিরালয় দেখতে গিয়েছিলেন জেনে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেন, “চিড়িয়াখানাটাও দেখে যান।”
মমতা জানান, এখনও মনস্থির করতে পারেননি তিনি।