লড়াই: লাভপুরের রাস্তায় টোটো চালাচ্ছে অপর্ণা। ছবি: কল্যাণ আচার্য।
আজ সব বন্ধুদের মতো সকালে উঠেই তৈরি হবে অপর্ণা। সরস্বতী পুজোর দিন শাড়ি পরে স্কুলে যাবে। মাধ্যমিকের আগে এই একটা দিনই পড়া থেকে ছুটি।
বছরের অন্য দিনগুলো অবশ্য এ ভাবে শুরু হয় না অপর্ণার। খুব ভোরে উঠে পড়াশোনা সেরে নেয়। তার পরে স্কুল যাওয়ার আগে পর্যন্ত টোটো চালায়। আবার স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত সওয়ারি নিয়ে তাকে দেখা যায় রাস্তায় রাস্তায়। তার কথায়, ‘‘দেবী সরস্বতীর আরাধনায় টোটোই আমার বাহন।’’
বীরভূমের লাভপুরের হরানন্দপুর গ্রামে বাড়ি অপর্ণার। স্থানীয় জামনা-ধ্রুববাটি বসন্তকুমারী বালিকা বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী। যৎসামান্য জমি ভাগচাষ আর বাবা সমীর হাজরার মোটরভ্যান চালানোর আয়ে চলে তাদের সাত জনের সংসার। অর্থাভাবে দাদা স্বার্থের অষ্টম শ্রেণি ও দিদি নয়নার দশম শ্রেণির বেশি পড়া এগোয়নি। তার উপরে দিদির বিয়ে দিতে গিয়ে ঘটিবাটিটুকুও বিকিয়ে গিয়েছে। দাদা এখন দিনমজুরি করেন। বাড়িতে অপর্ণার সঙ্গে থাকেন তার বাবা-মা, দাদু-ঠাকুমা, দাদা-বৌদি।
আরও পড়ুন: নতুন বেতনের মাসে ছ’হাজার কোটি ঋণ
এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে অপর্ণা। সে জন্য অঙ্ক ও ইংরেজি দু’টি বিষয়ে গৃহশিক্ষক রাখতে হয়েছে। বেড়েছে অন্য খরচও। বাবা-দাদার আয়ে সংসার সামলে সেই খরচ জোগানো সম্ভব হয় না। তাই পড়াশোনাই সংশয়ের মুখে পড়েছিল। কিন্তু হাল ছাড়েনি অপর্ণা। বাবার ভ্যান চালানো দেখে সে নিজেই বলে, সেও টোটো চালিয়ে উপার্জন করবে। তার জেদ দেখে বছর খানেক আগে বাবা কিস্তিতে একটি পুরনো টোটো কিনে দেন তাকে। সেই টোটো চালিয়েই কিস্তির টাকা মেটানোর পাশাপাশি পড়াশোনার খরচ জোগাড় করছে অপর্ণা। সে বলছে, ‘‘যত কষ্ট হোক, মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করতেই হবে। হাল ছাড়ব না।’’
সেই সংকল্প নিয়েই লাভপুরের জুবুটিয়া ব্যাঙ্ক মোড়, জামনা, বগতোড়, মামুদপুর, নন্দনপুর, কেমপুরের মতো গ্রামে গ্রামের রাস্তায় সকাল-বিকেলে টোটো নিয়ে রাস্তায় দেখা যায়। ছুটির দিনে রুটিনটা একটু বদলায়। সে দিন পড়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে সারাদিনই সওয়ারি নিয়ে দেখা যায় তাকে। মা মল্লিকাদেবী ও বাবা সমীরবাবু বলছেন, ‘‘শুধু নিজের লেখাপড়া বা কিস্তির টাকাই নয়, সংসারের অনেক চাহিদাও এখন পূরণ করে দেয় আমাদের অপর্ণা।’’
তার এমন লড়াকু মনোভাবের কথা পরিচিত এলাকাতেও। রানন্দপুরের সোমা প্রামাণিক, জুবুটিয়া ব্যাঙ্ক মোড়ের অসিত হালদারেরা বলেন, ‘‘মেয়েটির লড়াইয়ের কথা শোনার পর থেকেই উৎসাহিত করতে ওর টোটোতেই যাতায়াত করি।’’
টোটো চালাতে চালাতে গাড়ি চালানোই স্বপ্ন হয়ে উঠেছে অপর্ণার। তার কথায়, ‘‘সরকারি বাসের চালক হতে চাই। আমাদের মতো গরিব পরিবারে অন্য কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখাটাও তো স্বপ্নই।’’