এমন দেওয়াল লিখন হয়েছে ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন কুড়মি গ্রামে। নিজস্ব চিত্র
পঞ্চায়েত ভোটের আগে জঙ্গলমহলের রাজনৈতিক আকাশে কার্যত সিদুঁরে মেঘ!
শাসকের ‘জয় বাংলা’, বিরোধী গেরুয়া শিবিরের ‘জয় শ্রীরাম’ নয়, কুড়মি গ্রামের দেওয়াল গুলিতে জ্বলজ্বল করছে ‘জয় গরাম’ (কুড়মি দেবতার উদ্দেশ্যে জয়ধ্বনি)। সঙ্গে লেখা হয়েছে- ‘দেওয়ালে কোনও রকম রাজনৈতিক প্রচার নিষিদ্ধ’। কোথাও লেখা- ‘আমার দেওয়াল আমারই থাক’। আবার পর পর দেওয়াল জুড়ে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে, ‘অল ওয়াল ফর কুড়মি আপটু এসটি’। এমনই প্রচারে শুরু হয়েছে কুড়মি সংগঠনের জনজাগরণ কর্মসূচি। ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলি দেওয়াল দখলের সুযোগই পাচ্ছে না।
জনজাতি তালিকাভুক্তির দাবিতে নিচুতলা থেকে সংগঠন গড়তে একযোগে তিনটি কুড়মি সংগঠনের মিলিত ঘাঘর ঘেরা কেন্দ্রীয় কমিটির এমন কর্মসূচিতে চিন্তিত রাজনৈতিক দলগুলি। কুড়মি সমাজ (পশ্চিমবঙ্গ), আদিবাসী জনজাতি কুড়মি সমাজ এবং কুড়মি সেনা-র মিলিত ঘাঘর ঘেরা কেন্দ্রীয় কমিটি গত মাসের গোড়া থেকে জঙ্গলমহলে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। টানা জাতীয় সড়ক অবরোধ, কলকাতার সিআরআই (কালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট) দফতর ঘেরাও করে ধর্নার মতো কর্মসূচির পরে গত ১ মে খড়্গপুর গ্রামীণের খেমাশুলিতে প্রকাশ্য সমাবেশে ১২ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, কোনও কুড়মি গ্রামে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা প্রচারে গেলে, তাঁদের ঘাঘর ঘেরা করে কুড়মিদের দাবি পূরণে তাঁরা কী করেছেন জানতে চাওয়া হবে। কুড়মি শিল্পীরা কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে শামিল হবেন না। কোনও রাজনৈতিক দলের সভা-মিছিলেও কুড়মিদের কেউ যাবেন না।কুড়মি রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের সমাজের দাবি পূরণে ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হবে, না হলে তাঁদের প্রতি কুড়মি সমাজেরও দায়দায়িত্ব থাকবে না।
কমিটির হুঁশিয়ারি, জনজাতি শ্রমিকদের ৮ ঘন্টার বেশি কাজ করালে, জঙ্গলমহলে কুড়মিদের জমিতে সব প্রতিষ্ঠানে জমিদাতাদের মূর্তি ও নামের ফলক না বসালেও ঘাঘর ঘেরা হবে।প্রতিটি কুড়মি গ্রামেই জনজাগরণ কর্মসূচি হবে। সমাজের দাবিকে অবহেলা করে কোনও কুড়মি যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাহলে তাঁকে সমর্থন করা হবে না। ঘাঘর ঘেরা কমিটিভুক্ত কুড়মি সংগঠনগুলি অঞ্চল ভিত্তিক জনজাগরণ কর্মসূচি শুরু করে দিয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েত ভিত্তিক সমাবেশে ওই ১২ দফা কর্মসূচি রূপায়ণের ডাক দেওয়া হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলি উদ্বিগ্ন। কারণ, সিংহভাগ কুড়মি গ্রামে এখনও কেউই দখল করতে পারেনি। ঘাঘর ঘেরা কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা রাজেশ মাহাতো, শিবাজি মাহাতো, কৌশিক মাহাতোরা একযোগে বলছেন, ‘‘মূলত রাজ্যের গড়িমসিতে কুড়মিদের জনজাতিভুক্তির স্বপক্ষে সংশোধিত সিআরআই রিপোর্ট কেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে না। বিরোধীরাও দায় এড়াতে পারেন না। রাজনৈতিক কর্মসূচিই কুড়মি গ্রামে করতে দেওয়া হবে না। আগে দাবি পূরণ, পরে রাজনীতি।’’
জেলা তৃণমূলের সভাপতি দুলাল মুর্মু কোনও মন্তব্য করতে চাননি। জেলার বাকি তৃণমূল নেতারাও মুখে কুলুপ এঁটেছেন। বিরোধীরা অবশ্য তৃণমূলকেই দুষছে। সিপিএমের ঝাড়গ্রাম জেলা সম্পাদক প্রদীপ সরকারের দাবি, ‘‘যে কোনও জনজাতির আন্দোলনকে সংবিধান সম্মতভাবে সমাধানের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের। বিগত কয়েকমাস ধরে বিভিন্ন জনজাতি ও কুড়মি সম্প্রদায়ের যে আন্দোলন হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের ভূমিকা সদর্থক নয়। আমরা এর প্রতিবাদ করছি।’’ বিজেপির রাজ্য নেতা সুখময় শতপথীরও বক্তব্য, ‘‘কুড়মিদের আন্দোলনকে রাজ্যের সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে না। রাজ্য সরকারের অনমনীয় মনোভাবের জন্যই গ্রামে-গ্রামে ক্ষোভ বাড়ছে।’’ জেলা কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা সুব্রত ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘জঙ্গলমহলের জনজাতি ও কুড়মিদের নিয়ে তৃণমূল ও বিজেপি বরাবরই রাজনৈতিক তাস খেলেছে। জনজাতি ও কুড়মিদের দাবি পূরণে দুই সরকারেরই সদিচ্ছা নেই। জঙ্গলমহলকে রাজনৈতিক শূন্যতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এই প্রবণতা বিপজ্জনক।’’