কুড়মি কারা? তাঁরা কী চান? —ফাইল চিত্র।
বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষকে ঘেরাও। বাড়িতে গিয়ে বিক্ষোভ। তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয় থামাতেও হামলার অভিযোগ। তৃণমূলের আদিবাসী নেত্রী তথা রাজ্যের মন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদার গাড়িতে হামলা। সব ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত কুড়মিরা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক গোটা ঘটনায় কুড়মিদের ‘ক্লিনচিট’ দিলেও বীরবাহাকে হেনস্থার অভিযোগে আদিবাসীদের যৌথ মঞ্চ বাংলা বন্ধের ডাক দিয়েছে। কুড়মি নেতা রাজেশ মাহাতোকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সব ঘটনা একসঙ্গে দেখলে দু’টি বিষয় বোঝা মুশকিল। এক, কুড়মি সমাজ কার পক্ষে, কার বিপক্ষে! দুই, সব রাজনৈতিক দলই কুড়মিদের নিয়ে কেন বিভ্রান্ত। তারা কুড়মিদের খুশি করতে চাইলেও ঠিক খুশি করতে পারে না। কারা এই কুড়মি? কী তাঁদের ইতিহাস? কীই বা তাঁদের দাবি?
ইতিহাস বলে, মানভূম অঞ্চলের ভূমিপুত্ররাই কুড়মি। ঝাড়খণ্ড এবং সংলগ্ন বাংলার ওই এলাকায় যখন সে ভাবে জনবসতি গড়ে ওঠেনি, তখন থেকেই সেখানে কুড়মিদের বসবাস শুরু বলে জানা যায়। বাংলা, বিহার (বর্তমান ঝাড়খণ্ড)-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জঙ্গল ঘেরা এলাকায় বসবাস শুরু করেন কুড়মিরা। অসমেও কুড়মি সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন। এমনকি, দক্ষিণ ভারতে ছোটনাগপুর মালভূমি এলাকাতেও এই সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। তবে মূলত কংসাবতী বা কাঁসাই নদীর পারে পারেই বসত গড়েন তাঁরা। জঙ্গল কেটে চাষাবাদ শুরু করেন। নৃতত্ববিদরা বলেন, এক সময়ে ‘অচ্ছুৎ’ বলে দূরে সরিয়ে রাখা হলেও পরবর্তী কালে কুড়মিদের ‘ক্ষত্রিয়’ হিসাবে মর্যাদা দেয় ময়ূরভঞ্জের রাজপরিবার।
এখন কুড়মিরা যে আন্দোলন করছেন তাতে মূল দাবি তিনটি। প্রথম ও প্রধান দাবি, কুড়মিদের তফসিলি জনজাতি তালিকাভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া, তাঁদের ভাষা কুড়মালিকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়া এবং তাঁদের মেনে চলা সারনা ধর্মের স্বীকৃতির দাবি তালিকায় রয়েছে। যদিও কুড়মিরা মনে করেন, প্রথম দাবিটি মানা হলে, অর্থাৎ তাঁদের তফসিলি জনজাতিভুক্ত করা হলে বাকি দু’টি হয়ে যাবে।
একটা সময় কিন্তু কুড়মিরা তফসিলি তালিকায় ছিলেন। আবার নিজেরাই সেই তালিকা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ব্রিটিশ ভারতে জনজাতি তালিকায় থাকা কুড়মিরা ১৯৩১ সালে তা থেকে বেরিয়ে যেতে চান। সেই সময়ে কুড়মিরা সামজিক উত্থান চেয়েছিলেন। পিছিয়ে থাকা শ্রেণির তালিকা থেকে বেরিয়ে তাঁরা ‘ক্ষত্রিয়’ হতে চেয়েছিলেন বিহারের কুর্মি, গুজরাতের পটেল, মহারাষ্ট্রের কুনবি সমাজের সঙ্গে নিজেদের ‘জাতিগত ঐক্য প্রমাণ’ করতে। তা হলে আজ বিপরীত দাবি কেন?
এর একটি উত্তর পাওয়া গেল জনবিন্যাস বিষয়ক গবেষক কুমার রাণার বক্তব্যে। তাঁর কথায়, ‘‘কয়েক দশকের মধ্যেই, আরও স্পষ্টভাবে বললে স্বাধীনতার পর, ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতিতে এমন কিছু পরিবর্তন দেখা দিল, যাতে কুড়মি-মাহাতোদের উপলব্ধি হল, আগের দাবিটা আত্মঘাতী ছিল। যেটা প্রত্যাশা ছিল, অর্থাৎ জাতি-কাঠামোর প্রকৃত ক্ষমতাবান অবস্থানে পৌঁছনো, সেটা তাঁরা পারলেন না। সেটা সম্ভবও ছিল না। কারণ এটা তো শুধু নাম বা জাতিগত তকমা পরিবর্তনের ব্যাপার নয়, উৎপাদনের প্রক্রিয়া ও বণ্টনের সঙ্গে এর যোগ। অন্য দিকে চাকরি, শিক্ষা ও সংসদীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতে সংরক্ষণের সুযোগও তাঁরা পেলেন না।’’
এই দাবি নিয়ে দেশের অন্যত্র সে ভাবে আন্দোলন না হলেও, বাংলায় তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর একটি ব্যাখ্যা অবশ্য রয়েছে। বাংলা ছাড়া যেখানে কুড়মিদের বাস বেশি, সেই এলাকা আলাদা রাজ্য (ঝাড়খণ্ড) হয়েছে। একটা সময়ে পৃথক রাজ্যের দাবি ছিল কুড়মিদের। ঝাড়খণ্ডে কুড়মিরা যে রাজনৈতিক গুরুত্ব পেয়েছেন তা কিন্তু এই বাংলায় মেলেনি। সেটাই কি ক্ষোভের নেপথ্য কারণ? কুমার রাণার দাবি, ‘‘ঝাড়খণ্ড রাজ্যের আন্দোলন আংশিক ভাবে সফল হওয়ার কারণে, অর্থাৎ কেবল পূর্বতন বিহার প্রদেশের দক্ষিণভাগের কয়েকটি জেলাকে নিয়ে ঝাড়খণ্ড রাজ্যটি গঠিত হওয়ার ফলে, পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাংশে প্রভাবশালী ঝাড়খণ্ড আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কুড়মি-মাহাতোরা ক্ষমতার অলিন্দে জায়গা করে নিতে পারলেন না। এই জায়গা থেকেই কুড়মি-মাহাতোদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ বাড়তে থাকে।’’
ঝাড়খণ্ড সরকার বিধানসভায় কুড়মিদের জনজাতি তালিকাভুক্ত করার ব্যাপারে অনুমোদন দেয়। কিন্তু ভারত সরকার এখনও সেটিকে স্বীকৃতি দেয়নি। এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি কুড়মিদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়া বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের বক্তব্য, ‘‘শুধু ঝাড়খণ্ড নয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারও অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকার এখনও পর্যন্ত সিআরআই (কালচারাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট)-এর রিপোর্ট জমা দেয়নি। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু করার নেই।’’ কুড়মিদের আন্দোলন প্রসঙ্গে দিলীপ বলেন, ‘‘যে কোনও কিছুর একটা পদ্ধতি রয়েছে। নিয়ম মেনে দাবি জানাতে হবে। কিন্তু এখন যে ভাবে এই আন্দোলন রেল রোকো থেকে শুরু করে হামলার মতো ঘটনায় হিংসাত্মক করা হচ্ছে তাতে সমাধান মিলবে না। বিষয়টা জটিল। তবে আমরা কখনওই তাঁদের দাবির বিরুদ্ধে নই। দীর্ঘ দিন কংগ্রেস এই ধরনের সমস্যা জিইয়ে রেখেছে।’’
কুড়মি নেতা রাজেশ মাহাতোকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। —ফাইল চিত্র।
রাজনীতির চোখে বিষয়টা সত্যিই স্পর্শকাতর। তৃণমূলও সে ভাবে বিষয়টা নিয়ে মুখ খুলতে চায় না। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কাজ তো রাজ্য সরকার করছে। এক সময়ে ওঁরা তফসিলি তালিকায় থাকলেও নিজেরাই বেরিয়ে যান। এখন আবার আদিবাসী সমাজ বিষয়টা নিয়ে একমত নয়। ফলে জায়গাটা স্পর্শকাতর। আমাদের সরকার রোটি, কাপড়া, মোকানের সমস্যা মিটিয়ে জঙ্গলমহলকে আগে শান্ত করেছে।’’
বাংলায় ১৫ লক্ষের মতো কুড়মির বাস। পুরুলিয়া জেলাতেই কুড়মি ভোটার ৩৫ শতাংশের উপরে। সম্প্রদায়গত অঙ্ক বরাবরই ভাল করে বিজেপি। সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে গোটা দেশেই বিজেপি এগিয়ে। বাংলাতেও কুড়মি অধ্যুষিত একমাত্র লোকসভা আসন থেকে বিজেপির সাংসদ জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো। তিনিও কুড়মি সমাজের প্রতিনিধি। জ্যোতির্ময়কে দীর্ঘ সময় রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদকও করা হয়েছে। এ ছাড়াও বিজেপির তিন জন কুড়মি বিধায়ক রয়েছেন। তৃণমূলেরও তিন জন। তাঁদের মধ্যে শ্রীকান্ত মাহাতো মন্ত্রীও হয়েছেন। এর আগে শান্তিরাম মাহাতোকেও মন্ত্রী করেছিল তৃণমূল। বাম জমানায় মন্ত্রী হয়েছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের সত্যরঞ্জন মাহাতো।
এখনকার মাহাতো সাংসদ বা বিধায়করা নিজেদের সম্প্রদায় কুড়মিদের আন্দোলন নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে চান না। জ্যোতির্ময়ের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করা হয়। তিনি প্রশ্ন শুনলেও ‘নতুন সংসদ ভবনের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকার জন্য’ কথা বলতে চাননি। আবার জয়পুরের বিজেপি বিধায়ক নরহরি মাহাতোও সে ভাবে মতামত জানাতে রাজি হননি। শুধু বলেন, ‘‘আমি তো কিছু বলতে পারব না। শৃঙ্খলাবদ্ধ দলের সদস্য হিসাবে আমি কিছু মন্তব্য করতে পারব না।’’
কিছু না-বলতে পারার পিছনে সম্ভবত রয়েছে একটি বড় কারণ। তা হল আদিবাসী ভোট। যা কুড়মি ভোটের থেকে অনেক বেশি। তাই রাজনীতিকদের চিন্তা, কুড়মিদের বেশি গুরুত্ব দিলে আদিবাসীদের বিরোধিতা হয়ে যাবে না তো! কারণ, বাংলায় কুড়মি-আদিবাসী সম্পর্ক সাপে-নেউলে। গেরুয়া শিবিরের অনেকের দাবি, কুড়মিদের নিয়ে মন্তব্য পরবর্তী নির্বাচনে বিশেষ সমস্যায় ফেলবে না দিলীপকে। কারণ, তাঁর লোকসভা এলাকায় কুড়মিদের তুলনায় আদিবাসী ভোট অনেক বেশি।
একই হিসাব কষছে তৃণমূলও। কুড়মিরা তাঁর গাড়িতে ভাঙচুরের পরে মুখ খুলেছিলেন বীরবাহা। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বক্তব্যে মিল ছিল না। আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে একাধিকবার ফোন করা হলেও সাড়া দেননি বীরবাহা। মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতোর ফোনও বন্ধ। আর পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সভাপতি তথা পিংলার বিধায়ক অজিত মাইতি তো বলেই দিলেন, ‘‘এ নিয়ে কিছু বলব না। যা বলার শীর্ষ নেতৃত্বই বলবেন।’’
আসলে পূর্বজদের নেওয়া সিদ্ধান্তেই ‘ভুগছেন’ আজকের বাংলার কুড়মিরা। একটা সময়ে তুলনামূলক ভাবে ‘এলিট’ শ্রেণির সদস্য হতে জাতিসত্তা বদলে ফেলেছিলেন তাঁরা। স্বাধীনতার প্রথম দু’দশক তাঁরা অপেক্ষা করেছেন। এখন মনে হচ্ছে, তুলনায় তফসিলি জাতি বা জনজাতি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্তেরা সরকারি সুবিধা পেয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছেন। অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণি বা ওবিসি হিসাবে সেই সুবিধা মিলছে না। রাজনৈতিক ভাবে উত্তরণের গতি রুদ্ধ হয়ে রয়েছে। সেই রাজনৈতিক চাহিদা থেকেই তাঁরা পিছন দিকে হাঁটতে চাইছেন। আবার রাজনৈতিক কারণেই সেই চাহিদা ক্রমে অনতিক্রম্য হয়ে উঠছে। শুধু তাই নয়, জঙ্গলমহলের দুই মূলবাসী সম্প্রদায় আদিবাসী ও কুড়মিদের মধ্যে সংঘাত বৃহত্তর হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করছে। আর সব রাজনৈতিক দলই দাঁড়িপাল্লায় ফেলে মাপতে চাইছে, কে ভারী আর কে হালকা। দুই বঞ্চনা বিরোধী আন্দোলন এক হয়ে যাওয়া যে কখনওই পছন্দ করে না রাজনীতি।