(বাঁ দিকে) রাহুল মুখোপাধ্যায়। কুণাল ঘোষ (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।
পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়কে সাসপেন্ড (নিলম্বিত) করার ঘটনায় টলিউডের অনেকেই যখন চলচ্চিত্র ফেডারেশনের উপর ক্ষুব্ধ, তখন তাতে নতুন মাত্রা যোগ করলেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। মঙ্গলবার নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে কুণাল ‘টলিউডের ভবিষ্যৎ’ নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। এবং এ-ও ইঙ্গিত দিয়েছেন, এখন কেউ হয়তো মুখ খুলছেন না। কিন্তু ভবিষ্যতে এর ফল ভুগতে হবে।
কুণাল লিখেছেন, ‘‘পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়ের ঘোষণায় ভুল থাকলেও শাস্তি সমর্থন করি না। আলোচনা হতে পারত। ফেডারেশনের কিছু কাজ টলিউডের ক্ষতি করছে। প্রযোজক, পরিচালকেরা বিরক্ত হচ্ছেন। কাজের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আজ কেউ মুখ খুলছে না, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাকছে। আরও কাজ আসার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হচ্ছে।’’
কুণালের গল্প অবলম্বনেই বাংলাদেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’তে একটি ওয়েব সিরিজ় তৈরি হচ্ছে। ঘটনাচক্রে, সেটি পরিচালনা করছেন রাহুল। সিরিজ়ের নাম ‘লহু’। যেখানে মাওবাদী নেত্রীর চরিত্রে অভিনয় করছেন সোহিনী সরকার। সেই সিরিজ়ের শুটিং হওয়ার কথা ছিল এ পার বাংলাতেই। কিন্তু যে হেতু বাংলাদেশের ওটিটি, তা-ই পশ্চিমবঙ্গে শুটিংয়ের খরচ বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ। যে হেতু বাংলাদেশের ওটিটি সিরিজ়টি তৈরি করছে, তাই এখানে শুটিং করার ক্ষেত্রে ‘আন্তর্জাতিক দর’ চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা সামর্থ্যে কুলোয়নি বাংলাদেশের ওটিটি গোষ্ঠীর। অভিযোগ, এর পর ফেডারেশনকে না জানিয়ে রাহুল গিয়ে গোটা ছবির শুটিং করে এসেছেন বাংলাদেশেই। তা প্রকাশ্যে আসার পরেই রাহুলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে ফেডারেশন। গত শনিবার এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে ফেডারেশন।
কৌতূহলের বিষয় হল, কুণাল টলিউডের ‘শুদ্ধকরণ’ প্রয়াসে কাদের নিশানা করতে চেয়েছেন? কুণাল কারও নাম করেননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠদের অনেকেই বলছেন, টলিউডের বিষয়ে ওয়াকিবহালদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, কুণালের নিশানায় কে বা কারা। রাজ্যের প্রভাবশালী মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাস ফেডারেশনের অন্যতম মাথা। অনেকের মতে, কুণাল তাঁর দিকেই ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। স্বরূপের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অবশ্য বলেন, ‘‘কুণালদা ব্যক্তিগত মত লিখেছেন। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। তবে কুণালদা যখন লিখেছেন, তখন আমরাও ভাবনাচিন্তা করব। প্রয়োজনে কুণালদার সঙ্গে কথাও বলব।’’
বস্তুত, রাহুল-প্রসঙ্গে রাজনৈতিক মতভেদও দূরে সরে গিয়েছে। কট্টর সিপিএম বলে পরিচিত পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় রাহুলের শাস্তি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ফেসবুকে একটি দীর্ঘ পোস্ট করেছেন। সেই পোস্টে কমলেশ্বর পরিচালকের স্বাধীনতা, বাণিজ্য বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কমলেশ্বরের সেই পোস্টটি আবার নিজের ফেসবুকে শেয়ার করেছেন তৃণমূল নেতা কুণাল। বেশ কয়েক বছর ধরেই টলিউডে একাংশের দাপট কায়েম রাখার জন্য নানা ধরনের ‘নিয়ম’ কার্যকর করার অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। অনেকের অভিযোগ, নিয়মের দোহাই দিয়ে বাংলায় শুটিং করার ক্ষেত্রে খরচ এতটাই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে, বলিউডের ছবিতেও এখন বাংলার গল্প রাখা হচ্ছে না। কারণ, তা হলেই বাংলায় শুটিং করতে হবে। তাতে ব্যয় বাড়বে। সূত্রের খবর, বলিউডে এই মুহূর্তে একটি ছবির কাজ চলছে যেখানে কলকাতার ট্রামের গল্প রয়েছে। কিন্তু সেই দৃশ্যের শুটিং হচ্ছে মুম্বইয়ে ট্রামের সেট তৈরি করে। টলিউডের প্রযোজকদের একাংশের বিদেশে গিয়ে বাংলা ছবি শুট করে আসার উদাহরণও রয়েছে। প্রকাশ্যে না-বললেও ‘কারণ’ কী বা কে, সেটা টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িতেরা বিলক্ষণ জানেন।
তবে রাহুলের না জানিয়ে বাংলাদেশ যাওয়া নিয়েও দ্বিধাবিভক্ত টলিউড। শাস্তির বিরোধিতা করলেও কুণাল যেমন মনে করেন, রাহুলের উচিত ছিল গোটা বিষয়টা ফেডারেশনকে জানিয়ে করা। আবার কারও কারও বক্তব্য, রাহুল কেন তাঁর ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’ বিকিয়ে দেবেন? বলিউডের এক বাঙালি পরিচালকের স্ত্রী বলেন, ‘‘কাল যদি বাংলার কোনও পরিচালক বিয়ে করেন, তা হলে কি ওয়েডিং ফোটোগ্রাফির ইউনিট ফেডারেশন থেকে ভাড়া করতে হবে? এটা কি মগের মুলুক?’’ সার্বিক ভাবে রাহুল নিয়ে আপাতত আলোড়িত টলিউড। যাতে প্রকাশ্যে চলে আসছে শাসকদল তৃণমূলের অন্দরের ‘দ্বন্দ্ব’ও।