পরীক্ষার দিন তিনেক আগে বাসের ঝাঁকুনিতে ধাক্কা খেয়ে ডান কাঁধের হাড় সরে গিয়েছিল তাঁর। ডান হাত নড়ানো চলবে না— বলে দেন ডাক্তার। এই অবস্থায় বেশির ভাগ পড়ুয়াই হয়তো পরীক্ষায় বসার সাহস পেতেন না। কিন্তু বিবেকানন্দ মিশন স্কুলের অভিষেক সেনগুপ্ত পরীক্ষার মুখে এমন ভাগ্যবিপর্যয়ের সামনে মাথা ঝোঁকাতে রাজি হননি। অতএব স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে একাদশ শ্রেণির এক জন ছাত্রকে তড়িঘড়ি রাইটার হিসেবে জোগাড় করা হল। আইএসসি পরীক্ষায় বসেন অভিষেক।
হাত নড়াচড়া বন্ধ করতে ডাক্তার ছেলেটির হাতে ব্যান্ডেজ করে শরীরের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েকটি পরীক্ষার পরে অভিষেক নিজেই হাত খুলে দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করেন। ওই ছাত্রের জেদ দেখে ডাক্তারও শেষমেশ রাজি হয়ে যান। এর পরে ডান হাতে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েই বাকি পরীক্ষাগুলি দিয়েছিলেন তিনি। অভিষেক তাঁর জেদের পুরস্কার পেয়েছেন। ৯৩.৭৫% নম্বর তাঁর ঝুলিতে। বাবা ভাস্কর সেনগুপ্ত বলছেন, “কোনও চাপ দিইনি, কিন্তু ও নিজেই চ্যালেঞ্জটা নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।”
ক্যালকাটা গার্লস স্কুলের গরিমা চৌধুরীর লড়াইটাও কোনও অংশে খাটো নয়। গত ডিসেম্বরে বাড়ির সবার সঙ্গে মন্দারমণি বেড়াতে গিয়ে প্যারাগ্লাইডিংয়ের সময়ে অনেক উঁচুতে বেলুন থেকে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। এখনও কারও সাহায্য ছাড়া বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে বা চলা-ফেরা করতে পারেন না। পরীক্ষার যুদ্ধে মাথা উঁচু করে লড়ে বিজয়িনী গরিমাও। আইএসসি পরীক্ষায় ৮৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন গরিমা। তাঁর বাবা হরিশঙ্কর জায়সবাল বলছিলেন, “পরীক্ষার সময়ে মেয়েকে একটি চেয়ারে বসিয়ে আমরা স্কুলে পৌঁছে দিতাম। ওই ভাবেই খাতায় লিখত সে। এই অবস্থাতেই মেয়ের এমন রেজাল্টে সত্যিই বুকটা ভরে যাচ্ছে।” শিরদাঁড়া-সহ শরীরের নানা অংশে গুরুতর চোট রয়েছে গরিমার। পরীক্ষার আগে বিছানায় শুয়ে শুধু মায়ের মুখে শুনেই পাঠ্য বইয়ের অংশ তিনি ঝালিয়ে নিতেন। শুনে শুনেই বাজিমাত করে ফেলেছেন তিনি।
এই পড়ুয়াদের অনেকের কাছেই পরীক্ষাটা স্রেফ পরীক্ষা ছিল না। দুর্যোগে পিছু হটে ভাগ্যের খেলার পুতুল হয়ে থাকতে চাননি গরিমা-অভিষেকরা। স্রেফ নম্বরের মাপকাঠি দিয়ে এই রেজাল্টকে কখনওই বিচার করা যাবে না, বলছেন তাঁদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
ক্যালকাটা বয়েজ স্কুলের সোহম চৌধুরীর লড়াইটাও কি কম! গত আড়াই বছর ধরে লিউকেমিয়া তাঁর নিত্য সঙ্গী। সোহমের বাবা সুজয় চৌধুরী জানান, ২০১১-র শেষের দিকে তাঁর ছেলের এই রোগ ধরা পড়ে। তার পর থেকেই চলছে লড়াই। নিয়মিত চলছে কেমোথেরাপি, রক্ত নেওয়া। ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য এক বছর স্কুলে যেতে পারেননি সোহম। তা সত্ত্বেও মনোবল ভাঙেনি। নতুন করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি।
আইএসসি-তে সোহম ৬৯.৭ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন। সোহমের বাবা এ দিন বলেন, “পরীক্ষার এই সাফল্য ওকে অনেকটা আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে।” স্কুলের শিক্ষকদের পরিশ্রম ও সহযোগিতাকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন সুজয়বাবু।
সেন্ট টমাস চার্চ স্কুলের ছাত্রী প্রিয়া কেডিয়ার জন্যও ভাল নম্বর পাওয়াটা বাড়তি আত্মবিশ্বাসের অক্সিজেন। আইএসসি-তে ৯৬.৭৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন প্রিয়া। জন্মের ক’দিন পর থেকে তাঁর ডান চোখের দৃষ্টি চলে যায়। বাঁ চোখেও ভারসা বেশি পাওয়ারের চশমা। ঈষৎ স্থূল চেহারার জন্যও প্রিয়াকে মাঝেমধ্যেই বন্ধুবান্ধবদের ঠাট্টার লক্ষ্য হতে হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার ফল বেরোনোর পরে কিন্তু প্রিয়াই হাসছেন। বলছেন, “অনেক হাসি-ঠাট্টা সইতে হয়েছে। আমি যে কিছু পারি, এটা বোঝাতেই পরীক্ষার নম্বরটা জরুরি ছিল।”
হাসছিলেন প্রিয়া। আত্মবিশ্বাসের হাসি অভিষেক-গরিমা-সোহমের মুখেও। এঁরা জানেন না, এই হাসি কতটা অক্সিজেন জোগাতে পারে অন্য অনেকের পাহাড় ডিঙোনোর লড়াইয়ে!