কেবল ধর্মান্ধ হলে রুশদির মাথার দাম তিরিশ লক্ষ ডলার বলে ঘোষণা করতে হয় কেন? ধর্মের কারণে যে মারবে, তাকে টাকা দেখাতে হয়? ফাইল চিত্র
পঁচাত্তর পার করা লেখক সলমন রুশদির উপরে কুড়ি সেকেন্ডে প্রায় কুড়ি বার ছুরির আঘাত নেমে আসার মুহূর্ত থেকে নিউ ইয়র্ক যেন ‘নাইটমেয়ার’ শব্দটির সঙ্গে জায়গা বদলাবদলি করে নিয়েছে।হিরোশিমা-নাগাসাকি কিংবা নাইন-ইলেভেন ঘটে গেছে যে পৃথিবীতে, সেখানে এক জন লেখক (তিনি যত বিখ্যাত এবং বিতর্কিতই হয়ে থাকুন না কেন) আক্রান্ত হলে এত আবেগতাড়িত হওয়ার কোনও কারণ আছে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মনে হয়, প্রতিদিনের যে স্থিতাবস্থা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, তার উপরে আঘাত ভয়ঙ্কর ব্যাপার, সন্দেহ নেই। কিন্তু যে সৃষ্টি কলম-তুলি-কিবোর্ড বা ছেনি-বাটালির জোরে কাটা গলার থেকেও অমৃত ঝরাতে পারে, তার উপরে আক্রমণ যেন পাখির ডানা ছেঁটে ফেলা।
ডিম পাড়তে নেমে পাখিরা যেমন আক্রান্ত হয়, তেমনই নিজের সৃষ্টির কথা বলতে গিয়ে এক জন জগদ্বিখ্যাত লেখক আক্রান্ত হলেন। এই সাদৃশ্য কী রকম যেন ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেয় মেরুদণ্ড দিয়ে। সেই স্রোত শীতলতর হয়ে ওঠে, যখন জানা যায় যে, এক চব্বিশ বছরের যুবক চৌত্রিশ বছর আগে প্রকাশিত একটি বইয়ের রচনাকারকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে মঞ্চে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাঁর উপরে। আদৌ কি সে ওই বইটি পড়েছে? পড়ার ক্ষমতা আছে তার? যদি পড়ত, তবে তো সে কোনও শয়তান বা পাপিষ্ঠকে নয়, এক জন কবিকে আবিষ্কার করত রুশদির রচনার ছত্রে ছত্রে। তার মনে পড়ে যেত ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’-এর ডাক্তার আজিজের কথা। ডাক্তার আজিজকে শিখতে হয়েছিল যে, রেডিয়ামের মতো ভারতবর্ষও ইউরোপের আবিষ্কার। কিন্তু ডাল লেকের শিকারার চালক তাঁকে অনুভব করিয়েছিলেন, ‘The ice is always waiting… just under the water’s skin’। কিংবা তার হয়তো স্মরণে আসত, ‘Joseph Anton’ নামের সেই স্মৃতিকথা, যেখানে পালিয়ে বেড়ানো এক লেখকের কলমে উঠে আসে কৌতুকের হীরকদ্যুতি, যা ‘এ বার কালী তোমায় খাব’র কায়দায় দৃশ্যমান মৃত্যুকে নিয়ে মজা করতেও পিছপা নয়। নইলে বই লেখার অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত কেউ কী ভাবেই বা ‘…ristle-te, rostle-te, mo, mo, mo./ Willoby-Wallaby, mo, mo, mo’ উচ্চারণ করতে পারেন, কিংবা পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন যে, তাঁকে খুন করার নির্দেশ জারি হয়েছিল১৪ ফেব্রুয়ারি, ‘It was valentine’s day’।
বসন্তে কি প্রেমের বাস, জলের ত্বকের ভিতরে সত্যিই কি বরফ পাওয়া যায় এখন আর? না কি দান্তে যতটুকু লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন, তার চেয়ে আরও বেশি আগুন জল আর মাটিকে করে তুলেছে এক আকাঁড়া ইনফার্নো, যেখানে আধো-দানবদের ছড়াছড়ি?
কিন্তু ওই চব্বিশ বছরের যুবক হয়তো ভিতরে ভিতরে এক রোবট মাত্র। স্যামুয়েল বেকেট তাঁর শরীরে ছুরি ঢুকিয়ে দেওয়া লোকটিকে ‘ছুরি মারার কারণ’ জিজ্ঞেস করতে গিয়ে উত্তর পেয়েছিলেন, “জানি না তো।” মৃত্যুর ছোবল খেয়েও জীবনে ফিরে আসা রুশদি হয়তো একই উত্তর পাবেন, তাঁকে ছুরিকাহত করা অচেনা অবয়বটির থেকে। সেই অবয়ব, ‘দ্য সেটানিক ভার্সেস’ সম্পর্কে যতটা অজ্ঞ, ঠিক ততখানিই অজ্ঞ ‘দ্য মুর’স লাস্ট সাই’ বিষয়ে। রুশদি যে এক পাড়ার গুন্ডাদের হুমকি খেয়েও অন্য পাড়ার গুন্ডাদের রেয়াত করেননি এক বিন্দুও, কে বোঝাবে?
কিছু এড়িয়ে যাওয়ার নেই, কারণ সবটাই পেরিয়ে যাওয়ার। ওই অচেনা অবয়বগুলি অনেক হয়েও এক। তার আক্রমণে প্রাণ দিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায়, গৌরী লঙ্কেশ, কালবুর্গি, দাভোলকর। আক্রান্ত হয়েছেন তসলিমা নাসরিন, জাফর ইকবাল-সহ আরও কত জন। বেঞ্জামিন মোলায়েজকে যারা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছিল বা মেরে ফেলেছিল বুখারিনকে, তারাও কি একই অবয়বের অন্তর্ভুক্ত নয়? বিশ্বজোড়া এক অশুইৎস্ রচনার কারিগর এরা, যেখানে মানুষের ভল্টে তার শরীরটুকু থাকতে পারে কেবল, মন কদাপি নয়।
এদের কেবল ধর্মান্ধ বললে অন্ধের হস্তীদর্শন হয়ে যায়, কারণ এরা আরও বেশি করে লোভান্ধ। কেবল ধর্মান্ধ হলে রুশদির মাথার দাম তিরিশ লক্ষ ডলার বলে ঘোষণা করতে হয় কেন? ধর্মের কারণে যে মারবে, তাকে টাকা দেখাতে হয়? রুশদির উপরে প্রাণঘাতী হামলা নিয়ে চাপা উল্লাসের স্রোত চলছে যে দেশের মিডিয়ার একটি বড় অংশে, ‘নরকের পথে শয়তান’ হেডলাইন দিয়ে খবর ছাপা হচ্ছে, সেই ইরান যখন উন্মুক্ত-উদার দেশ ছিল, তখন কেন আমেরিকা ও ইউরোপ তার পেট্রলের ন্যায্য মূল্য না দিয়ে নির্বিচারে শোষণ করত রেজা-শাহ-পহলভির সরকারকে সামনে রেখে? যে ধর্মীয় বিপ্লব মানুষের ন্যূনতম স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, ‘রিডিং লোলিটা ইন তেহরান’-এর লেখক আজার নাফিসির ভাষায়, ‘সৌন্দর্যকে ঢেকে দেয় কালো কাপড়ে’, সেই বিপ্লবই যদি হতদরিদ্র মানুষের পাতে দুটো রুটি আর দু’টুকরো মাংস বেশি দেয়, হাতে দেয় একটা ফল, তাকে অস্বীকার করবে কোন গরিব?
তাই অনন্ত প্রতিভাবান আর অসীম ভাগ্যতাড়িত রুশদি যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই দেশও কোনও সর্বরোগহর জড়িবুটি নয়, লাদেন থেকে হাদি, প্রত্যেকের নির্মাণে মেরিবাবার সক্রিয় ভূমিকা আছে।
আজ তার উন্নততম চিকিৎসা বিজ্ঞান রুশদিকে বাঁচিয়ে তুলুক, এটা কেবল রুশদির পাঠক নয়, বহু মানুষের প্রার্থনা। কিন্তু অন্যকে ধ্বংস করতে গিয়ে নিজের ধ্বংসের রাস্তা খুলে রাখা শক্তিরা কি সংযত হবে কখনও?
ধ্বংস না হলে বোধহয় সৃষ্টির গরিমা বোঝা যায় না। সতীর মৃত্যু না হলে নটরাজ নাচবেন কেন? ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’-এও দেখি ‘…Lord thy Creator who created Man from clots of blood’-এর উল্লেখ।
নিউ ইয়র্কের মঞ্চের এধারে-ওধারে লেগে থাকা রক্ত থেকে তাই নতুন মানুষ, নতুন লেখা জন্ম নেবেই। রুশদির কলমের তোলা প্রশ্ন, ‘Is birth always a fall?’ মিথ্যে করে নব আনন্দে জাগবেই প্রাণ, নতুন নতুন পৃষ্ঠায়।
সাহিত্যিক