দাপট: মঙ্গলবারের প্রতিযোগিতায় মেয়েরা। রাজারহাটের মহম্মদপুরে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
বয়স দশের গণ্ডি পেরোলেই এখানে বাড়ির লোকজন পাত্র খুঁজতে শুরু করেন মেয়ের জন্য। আর সেই মেয়েরাই কি না হাফ প্যান্ট, টি-শার্ট পরে ফুটবল নিয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে! এমনকি, কবাডি খেলতে মাঠে নেমেছেন বিবাহিত মহিলারাও। মঙ্গলবার এমনই এক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সাক্ষী থাকল রাজারহাটের মহম্মদপুরের ঢালিপাড়ার খেলার মাঠ।
মাঠে নামার লড়াইটা যদিও খুব একটা সহজ ছিল না পরভিনা-নাফিসাদের জন্য। বছর পাঁচেক আগের এক ডিসেম্বরে রাজারহাটের ঘুনিতে এ রকম একটি ফুটবল ম্যাচের পরে এলাকার লোকজন রীতিমতো হুমকি দিয়েছিলেন আয়োজক সংস্থাকে। আর মাঠে নেমেছিল যে মেয়েরা, তাদের কপালে জুটেছিল বাবা-কাকাদের মার। ম্যাচের শেষে তাদের তাড়া করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। মেয়ে হয়েও কেন ছেলেদের মতো মাঠে নেমেছে তারা— এই ছিল ‘অপরাধ’। যে ক্লাবের তরফে খেলার জন্য মাঠ দেওয়া হয়েছিল তাদেরও বলা হয়েছিল, মেয়েদের ফের মাঠ দিলে তার ফল ভাল হবে না।
বাধার মুখে পড়ে খানিক থমকে গিয়েছিল আয়োজক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটিও। এমন সময়েই ফের তাদের কাছে আসে ওই মেয়েরা। জানিয়েছিল, ফের মাঠে নামতে চায় তারা। এর পরে আর কোনও হুমকির সামনেই থমকে যায়নি সেই মেয়েদের ‘জয়-যাত্রা’। পরের বছরেই মহম্মদপুরে আয়োজন করা হয় ফুটবল প্রতিযোগিতার। পরপর দু’বছর একই মাঠে খেলার পরে মঙ্গলবার ফের মাঠে নেমেছিল সেই মেয়েরা। কারও পায়ে হাফ প্যান্টের নীচে লেগিংস, কারও হাঁটু পর্যন্ত মোজা।
তবে এ দিন খেলতে আসার আগের দীর্ঘ লড়াইটা মসৃণ ছিল না ওই মেয়েদের জন্য। গত কয়েক বছরে আস্তে আস্তে পরিবারের লোকজনকে বোঝানোর কাজ করেছে পরভিনা খাতুন, নাফিসা সুলতানা, ঈশিতা পারভিন, মোমেনা খাতুনেরা। কারও বয়স ১৪, কারও ১৬ বছর। একটু একটু করে রাজি করিয়েছে বাবা-কাকাদের। কারও পরিবার অবশ্য মেয়ের বিয়ে দিয়েই থেমেছে। কিন্তু তাতে দমানো যায়নি বাকিদের। অষ্টম শ্রেণির রিয়াসমিনা খটি এবং পরভিনা খাতুন প্রথম বার মাঠে নামার পরেই বাড়িতে বাবাদের বোঝাতে শুরু করেছিল। বলেছিল, ‘‘আমাদেরও খেলার অধিকার আছে। মেয়ে বলে কি খেলতে পারব না?’’ তাতে অবশ্য কাজ হয়েছে। এ দিন মেয়ের খেলা দেখতে মাঠে হাজির ছিলেন পরভিনা ও রিয়াসমিনার বাবা-মাও। তবে পরিবার মেনে নিলেও প্র্যাকটিস শেষে ফেরার পথে আজও বাঁকা মন্তব্য শুনতে হয় তাদের। তাতে অবশ্য কান দেয় না দুই মেয়ে। পড়াশোনা, সংসারের কাজে মাকে সাহায্য করার পাশাপাশি খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত। খেলার জন্য অনেকের লড়াই অবশ্য এখনও চলছে। কেউ কেউ বাড়িতে না জানিয়েই এ দিন নেমে পড়েছে মাঠে।
তবে শুধু স্কুলপড়ুয়ারাই নয়। এ বারের প্রতিযোগিতায় আয়োজনকারীদেরই চমকে দিয়ে কবাডি আর দড়ি টানাটানি খেলায় অংশ নিয়েছেন এলাকার প্রায় ৬০ জন বিবাহিত মহিলা! ঢালিপাড়া মাঠের ক্লাবের ছেলেরাও এগিয়ে এসেছেন তাঁদের উৎসাহ দিতে।
এ প্রসঙ্গে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে সুপ্রিয়া রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘এই সমস্ত জায়গায় মেয়েদের কোণঠাসা করে রাখা হয়। আমাদের লড়াই সেখান থেকে ওদের বার করে এনে নিজস্ব পরিচিতি দেওয়া। চেষ্টা চলছে। বাধাও আছে। তার পরেও আমরা আশাবাদী। কারণ, মেয়েরাই এগিয়ে আসছে।’’