গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
বিজেপি-র ১০০ আসন পাওয়াও কঠিন। বিধানসভা নির্বাচনের আগে এমন কথা অনুগামীদের বার বারই বলেছেন মুকুল রায়। অমিত শাহের ঠিক করে দেওয়া ২০০ পার করার স্বপ্নে যখন বিজেপি মশগুল তখন বার বার নিজের হিসাব জানাতে চেয়েছেন তিনি। একটা সময় পর্যন্ত দলের রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের বার বার বোঝাতে চেয়েছেন, সংগঠনের যা পরিস্থিতি তাতে বিধানসভা নির্বাচনে ৮০ থেকে ১০০ আসন পেতে পারে বিজেপি। কেন এমন পরিস্থিতি, কী করলে তার মোকাবিলা করা সম্ভব, কোন পথে প্রচার করা উচিত— এমন অনেক প্রস্তাবই তিনি দিয়েছেন। কিন্তু তাতে কান দেননি নেতৃত্ব। একেবারে শেষ দিকে বলাই ছেড়ে দিয়েছিলেন মুকুল। কারণ, দলের মধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠতে শুরু করে যে, তিনি নেতা-কর্মীদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিতে চাইছেন। এখন মুকুল তৃণমূলে ফিরে যাওয়ার পরে রাজ্যে বিজেপি-র অনেক নেতাই বলছেন, সে দিন মুকুলের কথা শুনলে নির্বাচনে ভরাডুবি হত না। মুকুলও তৃণমূলে ফিরতেন না।
তবে বিজেপির একাংশের দাবি, মুকুল কখনওই বিজেপি-তে কোণঠাসা ছিলেন না। দিলীপের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাল ছিল না ঠিক, তবে রাজ্য বিজেপি-র পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়র সঙ্গে সম্পর্ক যথেষ্টই আন্তরিক ছিল। আর মুকুলও বরাবর কৈলাসের সমর্থন পেয়েছেন। অন্য দিকে, দিলীপের সঙ্গে কৈলাসের সম্পর্কও ভাল ছিল না। ফলে রাজ্য বিজেপি-তে এক দিকে দিলীপ এবং অন্য দিকে, মুকুল-কৈলাস জুড়ির দু’টি আলাদা শিবির তৈরি হয়ে গিয়েছিল একটা সময়।
কী বলেছিলেন মুকুল? শুধু অনুগামীরাই নয়, সেই সময় নিন্দার সুরে রাজ্য নেতারা অনেকেই বলেছিলেন সে সব কথা। এখন আবার তাঁদের মুখেই আত্মসমালোচনার সুর। মুকুলের বক্তব্যে ৩টি বিষয়ে জোর ছিল।
প্রথমত, তিনি চেয়েছিলেন হাওয়ায় নির্ভর না করে বুথ স্তরের সংগঠনে জোর দেওয়া হোক। কারণ, জেলার পদাধিকারীরা রাজ্য নেতৃত্বকে যে রিপোর্টই দিক না কেন, মুকুল দাবি করেছিলেন, খাতায়কলমে যত বুথ কমিটি আছে বলে দেখা যাচ্ছে, বাস্তব ছবির সঙ্গে তার মিল নেই। হিসেবের গরমিল ও সংগঠনের খামতি নিয়ে সতর্ক হওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন মুকুল। কিন্তু বিজেপি-তে জেলা কমিটি মূলত হয় রাজ্য সভাপতির পছন্দে। ফলে দিলীপ ঘোষ বরাবর মুকুলের এই আপত্তিতে কান দিতে চাননি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কখনও কখনও বুঝলেও একেবারে শেষ দিকে সংগঠন মেরামতির সুযোগ নেই বুঝে হাওয়ায় ভরসা করায় মন দেন।
মুকুলের দ্বিতীয় আপত্তি ছিল নির্বাচনের প্রচারে ধর্মীয় মেরুকরণ নিয়ে। বার বার মুকুল বোঝাতে চেয়েছিলেন, কড়া হিন্দুত্বের লাইন নেওয়া ঠিক হবে না। এই ক্ষেত্রে মুকুলের বক্তব্য ছিল, মুসলমান ভোট বিজেপি একেবারেই পাবে না এটা ধরে নেওয়া ঠিক নয়। দলের সংখ্যালঘু নেতাদের গুরুত্ব দেওয়া হোক। মেরুকরণে জোর দেওয়ায় দলেরই অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হবে। ধর্মীয় আবেগে ধাক্কা লাগলে সংখ্যালঘু নেতা, কর্মীরাও বসে যাবেন। সেটা ভোটের ফলে প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে মুকুলের বক্তব্য ছিল, কট্টর মুসলমান বিরোধিতা করেও হিন্দু ভোট এককাট্টা করার মতো সংগঠন নেই গেরুয়া শিবিরের। মুকুল চলে যাওয়ার পরে রাজ্য বিজেপি নেতারা এখন সে সব সতর্কবাণী মনে করছেন।
মুকুলের তৃতীয় পরামর্শ ছিল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করা। তিনি দলের নেতাদের এটাও বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, বাংলার মানুষ এটাকে ভাল ভাবে নেবে না। যদিও দিলীপরা সেই পথে হাঁটেননি। শুভেন্দু অধিকারী বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার পরে ব্যক্তি আক্রমণ আরও বেড়ে যায়। এখন বিজেপি নেতারা কেউ কেউ তৃতীয় পরামর্শটি শোনা উচিত ছিল মনে করলেও দিলীপ অনুগামীরা বলছেন, ওটা মমতার প্রতি তাঁর আনুগত্য বোঝাতেই বলেছিলেন মুকুল।
তবে রাজ্য বিজেপি-র অনেকেই দিলীপেরই নিন্দা করছেন। তাঁদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে মুকুল সম্পর্কে সব চেয়ে বেশি আপত্তি গিয়েছিল দিলীপের তরফেই। কৈলাস একটা সময় পর্যন্ত মুকুলের কথা শুনলেও শেষ দিকে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। বড় মাপের যোগদান ছাড়া মুকুলের সঙ্গে অন্য বিষয়ে আলোচনাই করা হয়নি। উল্টে প্রচার করা হয়, মুকুল দলের আত্মবিশ্বাসে আঘাত করে চলেছেন। একটা সময় বলে কাজ হবে না বুঝতে পেরে নিজেই নিজেকে সরিয়ে নেন মুকুল।