সেই অ্যাপ কোথায়? গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রের মৃত্যুরহস্যের কিনারা পুরোপুরি হয়নি এখনও। তবে তদন্তকারীরা একটা বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত, এই মৃত্যুর নেপথ্যে রয়েছে র্যাগিং। র্যাগিং একেবারেই নতুন সমস্যা নয়। অতীতে, এ রাজ্যে বা অন্য রাজ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ‘সিনিয়র’দের অত্যাচারের বলি হতে হয়েছে অনেক নবাগতকেই। হইচই হয়েছে। একটা সময়ের পর কড়া ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই সমস্যা নির্মূল করা যায়নি। র্যাগিং রুখতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সারা বছরই নানা উদ্যোগ নেয়। প্রচার চলে ক্যাম্পাসে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে র্যাগিং রুখতে কমিটিও রয়েছে। ইউজিসি-র হেল্পলাইন নম্বর থেকে অনলাইনে অভিযোগ জানানোর পোর্টালও রয়েছে। এ সবের পরেও ২০১৭ সালে একটি অ্যাপ তৈরি করেছিল ইউজিসি। বলা হয়েছিল, এর মাধ্যমে র্যাগিংয়ের শিকাররা তৎক্ষণাত অভিযোগ জানাতে পারবেন। সেই অ্যাপের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাভরেকর। কিন্তু কোথায় সেই মোবাইল অ্যাপ?
২০১৭ সালের ২৯ মে নয়াদিল্লিতে হয়েছিল উন্মোচন। প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরো (পিআইবি)-র মাধ্যমে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক সেই খবর সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিল। সেই সময় কিন্তু অ্যাপের কোনও নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এই অ্যাপ যে কোনও অ্যানড্রয়েড ফোনে কাজ করবে। কেউ র্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছেন বুঝলেই সরাসরি অ্যাপের মাধ্যমে অভিযোগ করতে পারবেন। র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে কেন লড়াই করা প্রয়োজন, তার জন্য অ্যাপ কেন জরুরি, তা নিয়েও অনেক কিছু বলেছিলেন মন্ত্রী। পড়ুয়াদের মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার রুখতে কেন্দ্রীয় সরকার যে উদ্বিগ্ন তা জানিয়ে অ্যাপটি ‘অস্ত্র’ হয়ে উঠবে বলেও উল্লেখ করেছিলেন জাভড়েকর।
অ্যাপ উদ্বোধনের প্রচারও করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সংগৃহীত।
কিন্তু কোথায় সেই অ্যাপ? সাধারণ ভাবে অ্যাপ খোঁজার নির্ভরযোগ্য ও পরিচিত ক্ষেত্র ‘গুগল প্লে স্টোর’। না, সেখানে এমন কোনও অ্যাপের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ‘অ্যান্টি র্যাগিং’ বা ‘ইউজিসি অ্যান্টি র্যাগিং’ কোনও সার্চেই তেমন কোনও উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে না। ইউজিসির ওয়েবসাইটে কী রয়েছে? খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে অভিযোগ জানাতে টোল ফ্রি ফোন নম্বর (১৮০০-১৮০-৫৫২২) রয়েছে। মেল করে (helpline@antiragging.in) জানানোর পাশাপাশি অনলাইনে (www.antiragging.in এবং www.amanmovement.org) অভিযোগ জানানোর উপায়ও বলে দেওয়া রয়েছে। অনলাইনে অভিযোগ জানাতে গেলে র্যাগিংয়ের মুখোমুখি হওয়া পড়ুয়ার বিস্তারিত পরিচয়ের সঙ্গে প্রমাণ দেওয়ার সুযোগও রয়েছে। কিন্তু অ্যাপ নেই। ইউজিসির ওয়েবসাইটেও অ্যাপ সংক্রান্ত কোনও সন্ধান মেলেনি। কোনও উল্লেখও নেই।
এমন একটি অ্যাপ যে আসছে, উদ্বোধন হয়েছে সে কথা ছাত্র থেকে অধ্যাপকরা অনেকেই শুনেছেন বলে জানালেন। কিন্তু কেউই তা চোখে দেখেননি। কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ নিয়ে কোনও প্রচারও হয়নি। ওই ওয়েবসাইটে র্যাগিং রোখার সর্বশেষ যে নির্দেশটি রয়েছে, সেটির তারিখ ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর। অর্থাৎ মন্ত্রীর হাতে অ্যাপ উদ্বোধনের পরে। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং সব কলেজের অধ্যক্ষকে ইউজিসির তরফে নোটিস পাঠিয়েছিলেন সচিব রজনীশ জৈন। সেই নোটিসে অনলাইনে অভিযোগ জানানোর দু’টি পোর্টালের উল্লেখ থাকলেও অ্যাপের নামগন্ধ নেই।
এ বিষয়ে খোঁজ নিতে আনন্দবাজার অনলাইনের পক্ষে কলকাতা এবং জেলার একাধিক কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কথা বলা হয়েছে পড়ুয়া থেকে অধ্যাপকদের সঙ্গে। প্রায় সকলেই বলছেন, এমন অ্যাপের কথা তাঁদের জানাই নেই। বলছেন, থাকলে তো সেই সম্পর্কে নির্দেশ আসত। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আসেনি। তবে কি মন্ত্রী সূচনা করে দিলেও র্যাগিং বিরোধী অ্যাপ আদৌ তৈরিই হয়নি? ইউজিসি-র কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে সংস্থার এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আধিকারিক বলেন, ‘‘এমন একটা অ্যাপ তৈরি হবে বলে শোনা গিয়েছিল। কিন্তু পরে সেটা হয়েছে কি না, হলেও কেন সেটা নিয়ে প্রচার নেই তা বলতে পারব না।’’
মন্ত্রীর সূচনা করা এমন অ্যাপের অস্তিত্বের কথা জানা নেই ছাত্রনেতাদেরও। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কেন্দ্রের সরকারটা তো একটা ভাঁওতার সরকার। বলে অনেক কিছুই, কিন্তু করে না। এমন অ্যাপ যে রয়েছে সেটা আমাদের তো জানা নেই।’’ এমন অ্যাপের কথা জানা নেই অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)-র রাজ্য সম্পাদক সঙ্গীত ভট্টাচার্যেরও। তিনি বলেন, ‘‘অ্যাপ নেই, কিন্তু দরকার। আজকের সময়ে র্যাগিং রুখতে অ্যাপ তৈরি করা খুবই প্রয়োজন। যাদবপুরের ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। দেশের অনেক জায়গাতেই এটা হচ্ছে। আমরা চাই রাজ্য বিধানসভা এবং লোকসভায় একটি পড়ুয়াদের রক্ষা করার বিল আসুক। র্যাগিং রুখতে দেশে এবং রাজ্যে কড়া আইন প্রনয়ন খুবই জরুরি।’’
(পশ্চিমবঙ্গ শিশু সুরক্ষা কমিশনের উপদেষ্টা অনন্যা চক্রবর্তী রবিবার তাঁর একটি ফেসবুক পোস্টে যাদবপুরের মৃত ছাত্রের নাম না-লিখতে অনুরোধ করেছেন। এই মৃত্যুমামলা অপ্রাপ্তবয়স্কদের উপর যৌন নির্যাতন বিরোধী ‘পকসো’ আইনে হওয়া উচিত বলেও তাঁর অভিমত। কমিশনের উপদেষ্টার অনুরোধ মেনে এর পর আনন্দবাজার অনলাইন মৃত ছাত্রের নাম এবং ছবি প্রকাশে বিরত থাকছে।)