স্বপ্নদীপের মৃত্যু মামলায় পুলিশ হেফাজতে নিল দীপশেখর দত্ত (বাঁ দিকে) এবং মনোতোষ রায়কে। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রমৃত্যুর মামলায় গ্রেফতার দুই ছাত্রকে ২২ অগস্ট পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিল আদালত। দুই ছাত্রই আত্মপক্ষ সমর্থনে আদালতকে বলেছিলেন, তাঁদের নাম এফআইআরে নেই। যাদবপুরের বাংলা বিভাগের ছাত্রটি মৃত্যুর আগে তাঁর বাড়িতে ফোনে কথা বলার সময়ও তাঁদের নাম জানাননি। তা হলে কী ভাবে তাঁদের হত্যার মামলায় গ্রেফতার করা হচ্ছে? তবে আদালতে সেই যুক্তি গ্রাহ্য হয়নি। উল্টে যাদবপুরের ছাত্রের মৃত্যু মামলায় তদন্তকারী পুলিশ জানিয়েছে তারা পকসো আইনের ধারা জুড়তে পারে। কারণ যাদবপুরের মৃত ছাত্রের বয়স মৃত্যুর সময় ১৮ পূর্ণ হয়নি বলে পরিবার সূত্রে খবর। সে ক্ষেত্রে ওই ছাত্র নাবালক। এবং তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া অত্যাচারের অভিযোগে নাবালকের বিরুদ্ধে অপরাধ দমনের আইন পকসো জুড়বে বলেই পুলিশ সূত্রে খবর।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রমৃত্যু মামলায় রবিবার সকালে গ্রেফতার করা হয় দুই পড়ুয়া মনোতোষ ঘোষ এবং দীপশেখর দত্তকে। তার আগে শনিবার রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাঁদের। রবিবার বিকেল ৩টে নাগাদ আদালতে তোলা হয় দু’জনকেই। মনোতোষের আইনজীবী অমি হক এবং দীপশেখরের আইনজীবী সৌম্যশুভ্র রায় আদালতকে বলেন, এফআইআরে তাঁদের মক্কেলদের নাম নেই। আইনজীবীরা এ কথাও বলেন যে, এঁদের বিরুদ্ধে বড়জোর আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার মামলা হতে পারে, হত্যার মামলা নয়। কিন্তু সরকারি আইনজীবী এর পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, তদন্তে এই ঘটনায় অনেকেই জড়িত বলে ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসছে। তা ছাড়া এই ধৃত ছাত্র বা প্রাক্তনীরাও সব বলছেন না। তাই ঘটনাটির গভীরে পৌঁছনোর জন্যই এঁদের পূর্ণ মেয়াদের পুলিশি হেফাজত দেওয়া হোক।
যুক্তি হিসাবে সরকারি আইনজীবী দু’টি বয়ান পেশ করেছিলেন আদালতে। প্রথমে হস্টেলের রাঁধুনির কথা বলে তিনি জানান, ওই রাঁধুনি বিশদে বলেছেন, কী ভাবে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের উপর হস্টেলে অত্যাচার করা হয়। পরে এক ছাত্রের কথাও জানান তিনি। ওই ছাত্রের নাম না করে সরকারি আইনজীবী বলেন, ওই ছাত্রও জানিয়েছেন, যাদবপুরের হস্টেলে ছাত্রদের উপর হওয়া অত্যাচারের কথা। এর পরই তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে এমন অত্যাচার চলে আসছে দীর্ঘ দিন ধরেই। অথচ এখনও এই ঘটনায় গ্রেফতার এক প্রাক্তনী এবং দুই পড়ুয়া এ ব্যাপারে বিশদে কিছুই জানাননি। রবিবার এর পরেই আদালত দু’জনকে ১০ দিনের পুলিশি হেফাজত দেয়।
অন্য দিকে, যাদবপুরের ওই ছাত্রের মৃত্যুকে পকসো আইনে হওয়া অপরাধ বলে মন্তব্য করেছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সুরক্ষা কমিশনের উপদেষ্টা অনন্যা চক্রবর্তী। তিনি রবিবারই একটি ফেসবুক পোস্টে মৃত ছাত্রকে নাবালক বলে জানিয়ে লেখেন, এই মৃত্যুমামলা অপ্রাপ্তবয়স্কদের উপর যৌন নির্যাতন বিরোধী ‘পকসো’ আইনে হওয়া উচিত। এমনকি, এই কারণেই ওই ছাত্রের ছবি এবং নাম প্রকাশের ব্যাপারেও বিরত থাকা উচিত বলে নিজের অভিমত প্রকাশ করেন অনন্যা। এর কিছু পরে পুলিশ সূত্রেও জানা যায়, যাদবপুরের মামলাটিতে তাঁরা পকসো আইনের ধারা জুড়তে পারে।
গত বুধবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলের নীচে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রকে। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় যাদবপুরের হস্টেল আঁকড়ে পড়ে থাকা প্রাক্তনীদের দায়ী করেন মৃত ছাত্রের পরিবার। পরে শুক্রবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী তথা হস্টেলের আবাসিক সৌরভ চৌধুরীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁকেও ২২ অগস্ট পর্যন্তই পুলিশ হেফাজত দেওয়া হয়েছিল। পরে তাঁকে জেরা করেই ওই হস্টেলের আবাসিক আরও দুই ছাত্রের নাম পায় পুলিশ।
পুলিশের তরফে জানা গিয়েছিল, সৌরভকে জেরা করে তাঁদের মনে হয়েছিল যাদবপুরের ওই ছাত্রের উপর অত্যাচার হয়েছে। শিশু সুরক্ষা দফতরের তরফেও একটি বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছিল, মৃত ছাত্রের হাতে পোড়া দাগের চিহ্ন দেখতে পাওয়া গিয়েছে বলে জেনেছে তারা। এর পরই সৌরভকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মনোতোষদের গ্রেফতার করা হয়। শনিবার কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ)-এর উপস্থিতিতেই জেরা করা হয় মনোতোষ এবং দীপশেখরকে।
উল্লেখ্য, এই মনোতোষের ঘরেই ‘গেস্ট’ হিসাবে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রকে। এফআইআরে মৃত ছাত্রের বাবা জানিয়েছিলেন সে কথা। তিনি বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী তথা মেস কমিটির এক অন্যতম সদস্য সৌরভই সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
এ দিকে, রবিবার যখন মনোতোষ এবং দীপশেখরকে আদালতে তোলা হচ্ছে তার কিছু আগেই সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয় ডায়েরির পাতায় লেখা একটি চিঠির ছবি। চিঠিটি মৃত ছাত্রেরই ডায়েরিতে লেখা ছিল বলে দাবি। ইংরেজিতে লেখা সেই চিঠির নীচে ওই ছাত্রের নামও লেখা ছিল। যদিও আদালতে সরকারি আইনজীবী দাবি করেন, ওই চিঠি ওই ছাত্রকে দিয়ে জোর করে লেখানো হয়েছে। জোর করে সই করতেও বাধ্য করা হয়েছে। চিঠিটি লেখানোর ঘটনায় মনোতোষ এবং দীপশেখরও যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
(পশ্চিমবঙ্গ শিশু সুরক্ষা কমিশনের উপদেষ্টা অনন্যা চক্রবর্তী রবিবার তাঁর একটি ফেসবুক পোস্টে যাদবপুরের মৃত ছাত্রের নাম না-লিখতে অনুরোধ করেছেন। এই মৃত্যুমামলা অপ্রাপ্তবয়স্কদের উপর যৌন নির্যাতন বিরোধী ‘পকসো’ আইনে হওয়া উচিত বলেও তাঁর অভিমত। কমিশনের উপদেষ্টার অনুরোধ মেনে এর পর আনন্দবাজার অনলাইন মৃত ছাত্রের নাম এবং ছবি প্রকাশে বিরত থাকছে।)