মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
কেন্দ্রের বিলম্বিত বাজেট পেশের সন্ধ্যাতেই মঙ্গলবার বাংলার পাড়ায় পাড়ায় দুর্গাপুজোর বাজেট তৈরি শুরু হয়ে গিয়েছে। কলকাতা-সহ জেলার বড় পুজো কমিটিগুলির এক পুজোর শেষেই পরের বারের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু মাঝারি বা ছোট মাপের পুজো কমিটিগুলি অপেক্ষা করে থাকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুদান ঘোষণার জন্য। নির্মলা সীতারামন দেশের বাজেট ঘোষণার পরে পরেই পুজোর বাজেট বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছেন মমতা।
মঙ্গলবার মমতা জানিয়েছেন, এ বার দুর্গাপুজোর জন্য ক্লাবগুলিকে ৮৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। আগামী বছর তা ১ লক্ষ করা হবে। পাশাপাশিই তিনি ‘ফায়ার লাইসেন্স’ মকুব করা এবং বিদ্যুতের বিলেও ছাড়ের কথা ঘোষণা করেছেন।
সন্দেহ নেই, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় খুশি পুজো কমিটিগুলি। কিন্তু তার সঙ্গে খানিকটা চিন্তাও রয়েছে। কারণ, ওই অর্থ কোন কোন খাতে খরচ করা হবে। তবে শেষ পর্যন্ত সেটা সমস্যা হবে না বলেই উদ্যোক্তাদের আশা। চিন্তার কারণ অনুদানের নিয়মের কারণে। দুর্গাপুজোর জন্য অনুদান দেওয়া হলেও সে টাকা পুজোয় ব্যয় করা যায় না। প্রতিমা কেনা দূরে থাক, সিদ্ধি-সিঁদুর কেনার দশকর্মার ফর্দকেও ওই অর্থ খরচের হিসাবে দেখানো যাবে না। নিয়ম অনুযায়ী, পুরোহিতকে দেওয়া দক্ষিণা বা ঢাকির খরচও সরকারি অনুদানের অর্থে করা যায় না। খরচ দেখাতে হবে সাধারণ মানুষের স্বার্থে কিছু করার জন্য। সেই মর্মে নথিও জমা করতে হবে। তবেই মিলবে পরের বছরের অনুদান।
হুগলির উত্তরপাড়ার এক পুজো কমিটির সদস্য নান্টু সরকারের কথায়, ‘‘‘যখন করোনা ছিল, তখন স্যানিটাইজার, মাস্ক কিনে তার বিল জমা দেওয়া হয়েছিল। গরিব মানুষকে বস্ত্রদানের বিলও দেওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এখন করোনা নেই। ফলে খরচ দেখানোর উপায় কম। তবু কিছু তো একটা করতেই হবে। এখনও আমরা আলোচনা করিনি। সেটা পুজোর পরে করলেও চলবে।’’ আর এক পুজো উদ্যোক্তার অবশ্য দাবি, ‘‘বিল দেওয়া কোনও সমস্যা নয়।’’ তাঁর দাবি, ‘‘পুলিশ-প্রশাসনও বিষয়টা বোঝে। ফলে খুঁটিনাটি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও বিল দিতে সমস্যা করেন না। কারণ, মুখ্যমন্ত্রীর এই ভাবনা তাঁদেরও চাঁদা দেওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।”
প্রথম দিকে অবশ্য হিসাব জমা দেওয়ার এত কড়াকড়ি ছিল না। মমতা রাজ্যের পুজো উদ্যোক্তাদের ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া শুরু করেছিলেন ২০১৮ সালে। তখনই পুজো বাবদে বিদ্যুতের বিলে ২৫ শতাংশ ছাড়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ২০১৯ সালে অনুদানের পরিমাণ ২৫ হাজার টাকা এবং করোনার সময়ে এক লাফে ৫০ হাজার টাকা করা হয়। ২০২২ সালে তা বেড়ে ৬০ হাজার এবং ২০২৩ সালে ৭০ হাজার টাকা করা হয়। এ বার অনুদান বেড়ে হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা। মাঝখানের সময়ে অনুদানপ্রাপ্ত পুজো কমিটির সংখ্যাও বেড়েছে।
প্রসঙ্গত, রাজ্যের ক্লাবগুলিকে বার্ষিক অনুদান দেওয়ার প্রকল্প গত বছর বন্ধ করে দেয় নবান্ন। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরের বছর মুখ্যমন্ত্রী মমতা ক্লাবগুলির পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য আর্থিক অনুদান ঘোষণা করেছিলেন। বাছাই করা ক্লাবগুলি প্রথম বছরে এককালীন ২ লাখ টাকা এবং পরবর্তী ৩ বছর ১ লাখ করে মোট ৫ লাখ টাকা পেত। যদিও কোভিড পর্বে ২০২০ সাল থেকে ওই প্রকল্পে অর্থ দেওয়ার কাজ স্থগিত রাখা হয়। ২০২৩ সালে তা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তবে পুজো কমিটির অনুদান রয়েছে। যা নিয়ে একাধিক মামলা হয় কলকাতা হাইকোর্টে। ২০১৮ সালে সরকারি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন যুক্তিবাদী আন্দোলনের কর্মী সৌরভ দত্ত এবং দ্যুতিমান বন্দ্যোপাধ্যায় নামে হাই কোর্টের এক আইনজীবী। সেই সময়ে রাজ্যের পক্ষে আদালতে জানানো হয়েছিল, পুজো উদ্যোক্তাদের টাকা দেওয়া হচ্ছে ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ প্রকল্পের প্রচারের জন্য। পরে অন্য মামলার প্রেক্ষিতে হাই কোর্ট শর্তও বেঁধে দেয় রাজ্যকে। ২০২২ সালে পুজোর মুখে কলকাতা হাইকোর্ট ছয় শর্ত বেঁধে দেয় রাজ্য সরকারকে। ষষ্ঠ শর্তে বলা হয়েছিল, অনুদানের অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত নথি হাই কোর্টে জমা দিতে হবে। তিন মাসের সময় দেওয়া হয়েছিল রাজ্যকে।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, তার পরেই রাজ্য সরকার টাকা খরচ নিয়ে পুজো কমিটিগুলোর উপর নথি জমা দেওয়ার ‘চাপ’ দেয়। নিয়ম অনুযায়ী এখন পুলিশের ‘আসান’ অ্যাপের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। সেখানে একসঙ্গে সব রকম প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র পাওয়া যায়। কমপক্ষে দশ বছর ধরে পুজো চলছে, এমন কমিটিগুলি পুজোর অনুদানের আবেদন করতে পারে। গোটা রাজ্যে যত পুজো রয়েছে, তাদের স্থানীয় থানায় হিসাব জমা দিতে হয় পুজোর পরে।
সে বার মামলাকারীদের দাবি ছিল, রাজ্য সরকার সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা বকেয়া রেখেছে। ফলে পুজো কমিটিকে এই অনুদান দেওয়া সমীচীন নয়। জবাবে ইউনেস্কোর তরফে কলকাতার দুর্গোৎসবকে ‘হেরিটেজ’ তকমা দেওয়ার কথা তুলে ধরে রাজ্য জানায়, এটা শুধু রাজ্য নয়, দেশের জন্যও গর্বের বিষয়। সরকার হলফনামায় জানায়, সংবিধানের ৫১ (এ) ধারা অনুযায়ী হেরিটেজ রক্ষার দায়িত্ব দেশের প্রত্যেক নাগরিকের। সেই মোতাবেক রাজ্য সরকারের কাছে প্রত্যাশা করা হয়, তারা যেন এগুলির সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে। দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে উৎসব মসৃণ ভাবে পরিচালনার জন্য ওই অর্থ বরাদ্দ করা হয়। কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে উৎসাহিত করার জন্য নয়।
ফলে পুজো কমিটিগুলির দায়িত্বও বেড়ে যায়। সাধারণ ভাবে ছোট পুজোর ক্ষেত্রে অনুদানেই মিটে যায় সব খরচ। প্রতিমা থেকে মণ্ডপ, প্রসাদ থেকে আলো সব খরচ হয়ে যায় রাজ্যের অনুদানে। কিন্তু হিসাবে তা দেখালে চলে না। হাওড়া শহরের একটি পুজোর সঙ্গে যুক্ত সঞ্জয় জয়সওয়াল যেমন বলেছেন, ‘‘সরকারি নিয়ম তো মানতেই হবে। তাই নানা রকম বিল তৈরি করতে হয়। গত বার ৭০ হাজার টাকার বিল লেগেছিল। এ বার আরও ১৫ হাজার টাকার লাগবে। আমরা ঠিক করেছি, সেবামূলক খাতে গত বারের চেয়ে বেশি খরচ করব।’’