প্রতিস্থাপনের জন্য হাসপাতালে অঙ্গ পৌঁছে দিতে শহরের রাস্তায় গ্রিন করিডর। ফাইল চিত্র
একই দিনে গ্রিন করিডর করে ১৪ মিনিটে কিডনি, ১৫ মিনিটে লিভার এবং ২৫ মিনিটে হৃদ্যন্ত্র নিয়ে কনভয় ঢুকছিল এসএসকেএম হাসপাতালে। তিনটি বিভাগ দ্রুত হাত লাগায় অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কাজে। নভেম্বরের ৫ তারিখের ওই রুদ্ধশ্বাস প্রক্রিয়ায় সেই প্রথম একসঙ্গে তিনটি অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সাক্ষী থাকল এসএসকেএম। এর মাস চারেক আগেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল এই হাসপাতালে। রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে হৃদ্যন্ত্র প্রতিস্থাপনের নজির অবশ্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দখলে। এখনও পর্যন্ত শুধু তিনটি হৃদ্যন্ত্র প্রতিস্থাপন হয়েছে সেখানে। আরও এক ধাপ এগিয়ে সম্প্রতি ফুসফুস প্রতিস্থাপনের অনুমতি পেয়েছে এসএসকেএম।
অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সঙ্গে যুক্ত অনেকের মতে, বিপুল ব্যয়ের এই চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ নিখরচায় হওয়ায় এর সংখ্যা বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করা উচিত সরকারের। পাশাপাশি, মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘোষণার পরে পরিবারের অঙ্গদানে সম্মতি দেওয়াও তত জরুরি, যতটা প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিকাঠামো তৈরির। ৪ নভেম্বর মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে কোমায় চলে যাওয়া স্বামী অপ্রতিম ঘোষের ‘ব্রেন স্টেম ডেথ’ ঘোষণার পরে ঈপ্সিতা ঘোষকে অঙ্গদানে সম্মত করতে কোনও কাউন্সেলিং করাতে হয়নি। পরিবার সূত্রের খবর, প্রায় এক বছর আগে ওই দম্পতি অঙ্গদানের অঙ্গীকার করেছিলেন। সন্তোষপুরের বাসিন্দা অপ্রতিমের দু’টি কিডনি, লিভার এবং হৃদ্যন্ত্র চলে যায় কমান্ড হাসপাতালের এক এবং এসএসকেএমের তিন রোগীর কাছে।
তথ্য বলছে, এ দেশে বছরে ২৫ হাজার রোগীর লিভার প্রতিস্থাপন জরুরি। কিন্তু হচ্ছে মাত্র পাঁচ শতাংশ। বছরে ৫০ হাজার রোগীর হৃদ্যন্ত্র প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হলেও ২৭ বছরে হয়েছে ৩৫০টির কিছু বেশি! প্রতি বছর এ দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় থাকেন দেড় লক্ষ মানুষ। কিন্তু ৩০ জনের মধ্যে এক জন পান কিডনি।
গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরীর মতে, প্রত্যাশা মতো অঙ্গ প্রতিস্থাপন হচ্ছে না ঠিকই। তবে ২৫-৩০ লক্ষ টাকার চিকিৎসা সম্পূর্ণ নিখরচায় পাচ্ছেন সেই সব মানুষ, যাঁদের সরকারি পরিকাঠামোই একমাত্র ভরসা। সেটাও যথেষ্ট ইতিবাচক দিক।
এসএসকেএমের ডিরেক্টর মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সংখ্যার বিচারে হয়তো অঙ্গ প্রতিস্থাপনে প্রাইভেট হাসপাতালগুলি এগিয়ে। কিন্তু এক হাসপাতালে তিনটি অঙ্গ একই সঙ্গে একই দিনে প্রতিস্থাপন করার ঘটনা বোধহয় বেসরকারি ক্ষেত্রেও নেই। সুপার, ডেপুটি সুপার, ল্যাব টেকনিশিয়ান, চিকিৎসক, নার্স, ড্রাইভার-সহ আমাদের সকলের ৭-৮ ঘণ্টার টানটান লড়াই ছিল সে দিন। আগামিদিনে এমন আরও হওয়ার আশা রাখছি। কারণ, পূর্ব ভারতে প্রথম ফুসফুস প্রতিস্থাপনের অনুমোদন পেয়েছে এসএসকেএম।’’
দীর্ঘদিন ধরে অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ায় যুক্ত মুম্বইয়ের শল্য চিকিৎসক বৎসলা ত্রিবেদীর কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে যাবতীয় পরিকাঠামো পেয়েও এমস তার সে ভাবে সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। নিখরচায় পরিষেবা দিয়ে এসএসকেএম যা করছে, তাতে আরও গতি এলে সকলেই উপকৃত হবেন।” পাশাপাশি তাঁর দাবি, প্রতিস্থাপন বাড়াতে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই। সরকারি নির্দেশিকাকে প্রাসঙ্গিক করা, সর্বস্তরের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি, মানুষের মধ্যে অঙ্গদানের সচেতনতা বাড়ানো এবং চিকিৎসক ও কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আবশ্যিক।
স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলছেন, “অঙ্গদান বাড়াতে সরকার কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কলকাতার ৮০ কিলোমিটারের মধ্যে জাতীয় সড়কের ধারের কলেজগুলিতে সচেতনতার প্রচার হচ্ছে। রেডিয়ো-টেলিভিশনেও প্রচার হবে। অঙ্গদান করা ব্যক্তির সম্মানে প্রতিস্থাপিত হাসপাতালে তাঁর নাম-সহ ফলক থাকবে। কলকাতার নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে থাকা হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। রোগীর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে ‘গ্রিফ কাউন্সেলিং’-এর পাঠ দেওয়া হবে।”