এন্টালি এলাকায় দুঃস্থদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছে পুলিশ। নিজস্ব চিত্র।
অশীতিপর দম্পতি। ছেলেমেয়েরা কলকাতার বাইরে থাকেন। লকডাউনের মাঝেই ফুরিয়ে গিয়েছে প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয় ওযুধ। দোকান খোলা আছে ওযুধের। কিন্তু বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। অশীতিপর দম্পতির শারীরিক ক্ষমতায় কুলোয় না, পায়ে হেঁটে অত দূর গিয়ে ওযুধ আনা। বাড়ির পরিচারিকাও আসছেন না যে, এনে দিতে পারবেন! উপায়ন্তর না দেখে মনে বেশ খানিকটা দ্বিধা নিয়েই বৃদ্ধ ফোন করেছিলেন যাদবপুর থানায়।
পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। ফোনের ওপারে থাকা পুলিশকর্মী জেনে নিয়েছিলেন নাম এবং ঠিকানা। কিছু সময় পরেই এক পুলিশ অফিসার এসে পৌঁছন ওই দম্পতির কাছে। তাঁর কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে পৌঁছে দিয়ে যান ওষুধ। জানিয়ে যান, লকডাউন উঠলে দোকান থেকে কেউ এসে ওষুধের দাম নিয়ে যাবে। এতটাও আশা করেননি ওই দম্পতি।
যেমনটা আশা করেননি ডেকার্স লেনের একটি খাবারের দোকানের বাসন মাজার কাজ করা মহম্মদ নিজাম। বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি বসেছিলেন রাস্তার পাশে একটা বন্ধ খাবারের দোকানের বাক্সের উপর। তাঁর কথায়, ‘‘বন্ধ হওয়ার দ্বিতীয় দিন থেকে দু’বেলার খাবার নিয়ে ভাবতে হয়নি। থানার বড়বাবু নাম লিখে নিয়ে গিয়েছেন। তার পর থেকে নিয়ম করে থানা থেকে এসেছে খাবার।’’ ছোটবেলা থেকে কলকাতার ফুটপাথে বড় হওয়া নিজামের অভিজ্ঞতায়, পুলিশ মানেই ছিল ‘হল্লা পার্টি’। রাতবিরেতে ফুটপাথের বিছানা থেকে তাড়া করে তুলে দেবে। শুরু হবে ধমক-ধামক। সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে এই পুলিশকে কিছুতেই মেলাতে পারছেন না অনেকেই।
আরও পড়ুন: হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপে করোনা সংক্রান্ত মেসেজ শেয়ার করলেই কি গ্রেফতার?
মেলাতে পারছেন না খোদ পুলিশকর্মীরাও। বৌবাজার থানার সার্জেন্ট সৌরভ দাস। ২৭ মার্চ খবর পেলেন, তাঁর থানা এলাকার গোপী বোস লেনের বাসিন্দা ৭২ বছরের বৃদ্ধা ভগবতী দে প্রায় অনাহারে রয়েছেন। বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। হঠাৎ করেই লকডাউন। বাড়িতে খাবার-দাবার নেই। সৌরভবাবু সেই বৃদ্ধাকে প্রথমে নিয়ে আসেন থানায়। সেখানে তাঁর খাবারের ব্যবস্থা করেন। তার পর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসেন ১২ দিনের বাজার। নিজেই এক সহকর্মীকে তিনি বলছিলেন, ‘‘চাকরিতে ঢোকা ইস্তক তো চোর ডাকাত ধরা, আর গন্ডগোল সামলানোর কাজ করেছি। এই লকডাউন আমাদের ভূমিকাটাই বদলে দিয়েছে। অন্য রকম মনে হচ্ছে নিজেকে।”
টালা থেকে টালিগঞ্জ, বাইপাস থেকে বেহালা— গোটা শহর জুড়ে তৈরি হয়েছে নতুন ট্যাগ লাইন— অচল শহরে, সচল জীবন, সৌজন্যে কলকাতা পুলিশ।
ভগবতী দে-কে খাওয়াচ্ছেন বৌবাজার থানার সার্জেন্ট সৌরভ দাস। নিজস্ব চিত্র।
নরমে-গরমে:
লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই নরমে-গরমে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে পুলিশ। ২৩ মার্চ, সন্ধ্যা ৬ টা। এক দিকে পুলিশ কর্মীরা তাড়া করে বাড়ি পাঠাচ্ছেন বিভিন্ন গাড়ি, বাইক স্কুটার আরোহীদের। অন্য এক দল ধৈর্য ধরে ভিন্রাজ্য থেকে আসা কয়েক হাজার এ রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিককে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন। পরের দিন অর্থাৎ ২৪ মার্চ সকালে এক দল পুলিশ কর্মী প্রয়োজনে লাঠি হাতে তাড়া করেছেন রাস্তায় থাকা অহেতুক জটলাকে। আবার আতঙ্কে হুড়োহুড়ি করা মানুষ, যাঁরা দোকানে-বাজারে ভিড় করেছিলেন, তাঁদের সামলেছেন মানবিকতার সঙ্গে। ২৫ মার্চ সকালে দোকানের সামনে কয়েক হাত অন্তর চকের দাগ কাটতে কাটতে এক পুলিশ আধিকারিক বলেছিলেন, ‘‘সব সময় তাড়া করলে হবে? সবাই তো দায়ে পড়ে ভিড় করছেন। নিজেকে দিয়ে ভাবুন। বোঝাতে হবে।” আবার সেই পুলিশকর্মীকেই খানিক পরে বেশ কড়া মেজাজে দেখা গেল রাস্তায়। কয়েক জন বাইক আরোহী যুবককে আটকে রেখেছেন তিনি।
এ ভাবেই রোজ চলছে। গত ক’দিনে ২ হাজারের বেশি লোককে গ্রেফতার করেছে কলকাতা পুলিশ লকডাউন অমান্য করায়।
অন্নদাতা:
গোটা শহর তালাবন্দি। কিন্তু ফুটপাথই যাঁদের বাড়িঘর? তাঁদের কী হবে? বিভিন্ন ব্যবসায়ী বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যৌথ ভাবে শুরু হল খাবার বিলি। সব থানা এলাকায় পুলিশকর্মীরা তৈরি করলেন লম্বা তালিকা। শুধু ভবঘুরে বা ভিক্ষাপজীবী নন, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের তালিকাও বানানো হয়। অনেকেই হয়তো হোটেলে খান। সেই হোটেলও বন্ধ। রোজগারও নেই। তা হলে কী করবেন ওই মানুষরা? প্রতিটি থানাতে হয় বসিয়ে, নয়তো খাবারের প্যাকেট তৈরি করে সেই মানুষদের দু’বেলা পৌঁছে দেওয়া শুরু করল পুলিশ।
বন্ধু পুলিশ:
গোটা শহরে যাদবপুরের দম্পতির মতো অনেক মানুষ আছেন যাঁরা বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বাজার-দোকানের ওই ভিড় ঠেলে চাল-আটা-তেল মজুত করা সম্ভব নয়। সেখানেও সহায় পুলিশ। শীর্ষ পুলিশকর্তাদের নজরদারিতে সেই সমস্ত অপারগ মানুষদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হল খাবার। যাতে বাইরে যেতে না হয়। পরিস্থিতি বুঝে স্থানীয় বাজারের সব্জি থেকে মাছের ব্যবসায়ীদের বলা হল হোম ডেলিভারি করতে।
আরও পড়ুন: ‘করোনা হলে আপনার দায়িত্ব’, হুমকির মুখে ভাড়াবাড়ি ছাড়তে হল নার্সকে!
যেমন, নিউআলিপুর। সেখানকার থানার এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এখানকার বাজারে বিক্রেতাদের রাজি করানো হয়েছে হোম ডেলিভারি করতে। দোকানদারদের নাম, ফোন নম্বর দিয়ে তালিকা তৈরি করে পৌঁছে দেওয়া হয় বাড়ি বাড়ি। যাতে এক ফোনে বাড়িতে বসেই পাওয়া যায় মাছ, মাংস, সব্জি থেকে মুদি দোকানে মালমশলা।”
নজরে পশুপাখিও:
লকডাউনে মানুষের মতো অনাহারে থাকার অবস্থা পথকুকুর থেকে শুরু করে অনেক প্রাণীর। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে পথকুকুরদের খাবার দিচ্ছে কলকাতা পুলিশ। বিশেষ করে অফিসপাড়ায়। উদ্ধার করা হয়েছে পাড়ার পার্কে থাকা পাখিদের। তুলে দেওয়া হয়েছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের হাতে।
মানুষের পাশাপাশি পশু পাখিদেরও খেয়াল লাখছে কলকাতা পুলিশ। নিজস্ব চিত্র।
এর পরেও আছে পুলিশের আসল কাজ। লকডাউনের ফলে অপরাধ কমেছে, কিন্তু বন্ধ তো হয়নি। পোস্তার পাইকারি বাজারে দাঁড়িয়ে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের গাড়িতে মালপত্র তোলার দেখভাল করার পাশাপাশি পুলিশকে নজর রাখতে হচ্ছে যাতে গুজব না ছড়ায়। মানুষকে বিভ্রান্ত না করা হয়। আর তার মধ্যেই সামলাতে হচ্ছে বোমা-গুলিও।
কলকাতার পূর্ব শহরতলির একটি থানার আধিকারিক বলেন, ‘‘ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। আমার এলাকা অন্য এলাকা থেকে একটু আলাদা। এই গিয়ে সবাইকে বাড়ি ঢুকিয়ে এলাম। থানায় আসতে আসতে খবর পেলাম আবার রাস্তায় ভিড়। কী করব? বিরক্তি চেপে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
এই অভিজ্ঞতা অনেক আধিকারিকেরই হচ্ছে। অন্য এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, ‘‘আমি যে পুলিশ আবাসনে থাকি, সেখানে গত তিন দিন জল নেই। কেনা জল দিয়ে চলছে ৮২টা পুলিশ পরিবারের। থানায় স্নান করছি, যাতে বাড়ির জল খরচ না হয়। তা-ও হাল ছাড়ছি না।”
হাল ছাড়েননি সেই সমস্ত পুলিশকর্মী, যাঁদের নিজের বাইক নেই বা সরকারি গাড়ি নেই। পণ্যবাহী গাড়িতে চেপেই অনেকে যাতায়াত করছেন বাড়ি থেকে থানায়। না পারলে থেকেই যাচ্ছেন থানাতেই।
বাহিনীর এই ভূমিকা প্রসঙ্গে কী বলছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা? তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতা পুলিশ দেখিয়ে দিল যে তাঁরা মাল্টি টাস্কিং করতে পারেন। প্রতিদিনকার অপরাধ দমন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার বাইরেও আমার অফিসার এবং বাহিনীর সদস্যেরা ব্যক্তিগত ভাবে উদ্যোগী হয়েছেন যাতে লকডাউন বলবৎ থাকে। কিন্তু সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনের সমস্যাও দূর করার চেষ্টা করছি। আমরা পথকুকুর এবং প্রাণীদেরও খাবার পৌঁছে দিচ্ছি। সে দিন গোটা শহর ঘুরে বেড়াতে গিয়ে দেখেছি, এই কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে আমার গোটা বাহিনী মানসিক ভাবে তৈরি। আমি শুধু শহরবাসীকে অনুরোধ করব তাঁরা যাতে লকডাউনকে সফল করতে আমাদের সাহায্য করেন।”
এর মধ্যে বিভিন্ন থানা এলাকায় কলকাতা পুলিশের দল গলা ছেড়ে গান গাইছেন, ‘‘উই শ্যাল ওভারকাম, উই শ্যাল ওভারকাম, সাম ডে...”
লকডাউন-অতিমারির আতঙ্কের মধ্যে শহরবাসীর মনোবল জোরালো করছেন তাঁরা গান গেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বোধহয় নিজেদেরও নতুন করে লড়াইয়ের জন্য তৈরি করছেন তাঁরা।