গত বছর নবমীর ভোর। উত্তর কলকাতার ব্যস্ত মোড় দেখে মনে হচ্ছিল, কেউ যেন এক গাড়ি জঞ্জাল উপুড় করে দিয়ে গিয়েছে!
না, অষ্টমীর রাতে কোনও জঞ্জালের গাড়ি উল্টোয়নি। সেগুলি আদতে সারা রাত ধরে দর্শনার্থীদের ফেলে যাওয়া ফুচকার বাটি, নরম পানীয়ের গ্লাস।
এ ভাবেই ফি বছর মহানগরে পুজো আসে, সঙ্গে নিয়ে আসে প্রচুর বর্জ্যও। যা রাস্তায় পড়ে এবং পরে ভাগাড়ে জড়ো হয়ে বাড়িয়ে তোলে দূষণের ভার। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে পরিবেশকর্মীরা বিরক্ত। তাঁরা বলছেন, কোটি-কোটি টাকা ব্যয়ে আনন্দোৎসব হয়। কিন্তু তার বিনিময় পরিবেশ বিষিয়ে উঠবে কেন? ‘‘এ বছর যখন সরকার পুজো প্রতি ১০ হাজার টাকার জোগান দিচ্ছে, তখন কেন পরিবেশ দূষণ রোধে কড়াকড়ি হবে না,’’— প্রশ্ন তুলছেন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়।
শহরে থিম পুজোর ভি়ড়ে ‘পরিবেশ’ কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই উঠে আসছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, থিমের বাইরে বেরিয়ে পুজো কমিটিরা কি আদৌ পরিবেশ বাঁচাতে আগ্রহী? নাকি শুধু থিমটুকু হয়ে গেলেই দায়িত্ব শেষ?
পরিবেশকর্মীদের হিসেব বলছে, বৈশাখ মাস থেকেই শহরে পুজোর ব্যানার, ফেস্টুন ছেয়ে যায়। সব মিলিয়ে হিসেবটা কয়েক হাজার। পুজো যত এগিয়ে আসে, বিজ্ঞাপনের ব্যানারও বা়ড়তে থাকে। কিন্তু পুজোর পরে এই সব ব্যানার যায় কোথায়? সদুত্তর নেই কারও কাছে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের একটি সূত্র বলছে, যথাযথ ভাবে পুনর্ব্যবহার হওয়ার বদলে এগুলি ভাগাড়ে ডাঁই করা হয়। এমনিতেই কঠিন বর্জ্যের ভারে ভাগাড়ের জায়গা ফুরোচ্ছে। তার উপরে এই ভার চাপলে তো আরও মুশকিল! তা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন? ‘‘পুরসভাগুলির সেই পরিকাঠামো কোথায়? আমরা তো বারবার করেই এ কথা বলছি,’’ বক্তব্য ওই সূত্রের।
এর সঙ্গেই জুড়ছে থার্মোকল, প্লাস্টিকের দাপট। তা সে ক্যারিব্যাগ হোক কিংবা থালা, বাটি, গ্লাস। ‘‘আগে তো শালপাতার বাটিতে ফুচকা, ঘুগনি বিক্রি হত। এখন তো সে সব প্লাস্টিকের!’’— বলছেন এক পুজোকর্তাই। পুজো মণ্ডপকে ঘিরে যে সব দোকান বসে, তারাই এ সব ব্যবহার করে। পরিবেশকর্মীদের যৌথ সংগঠনের তরফে নব দত্তের বক্তব্য, ‘‘পুজো চত্বরকে ঘিরে এ সব দোকান বসে। পুজো মণ্ডপের কাছে দোকান দিতে হলে প্লাস্টিক ব্যবহার করা চলবে না, এ নিয়ম তো পুজো কমিটি চালু করতেই পারে। কেন
পুজোকে প্লাস্টিকমুক্ত উৎসব করার চেষ্টা হবে না!’’
পুজো উদ্যোক্তাদের সংগঠন ‘ফোরাম ফর দুর্গোৎসব’-এর সম্পাদক শাশ্বত বসু অবশ্য দাবি করছেন, ‘‘সব পুজো কমিটি পরিবেশ বাঁচাতে সক্রিয়। রোজ দু’বেলা জঞ্জাল সাফাইয়ের ব্যবস্থাও করে। পরিবেশ বাঁচিয়ে পুজো হোক এটা
আমরাও চাই।’’
কিন্তু পুজোর মধ্যে সেই পরিবেশ সচেতনতা কোথায়? ‘ফোরাম’-এর এক সংগঠক বলছেন, সার্বিক ভাবে এই নিয়ম চালু করবে কে? কলকাতার তথাকথিত বড় পুজোরাই তো এ দিকে নজর দেয় না। বহু বড় মাপের পুজোয় এখনও ক্যারিব্যাগ চালু রয়েছে। দু’-একটি পুজো অবশ্য ভিন্ন পথে হাঁটে। কিন্তু পুজোর ভিড়ে সেগুলি আড়ালেই থেকে যায়।
তা হলে বে়ড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধবে কে? বিশ্বজিৎবাবুর মতে, এ কাজে পরিবেশ দফতর এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এগিয়ে আসা উচিত। পরিবেশবিধি মানতে বাধ্য করা উচিত পুজোর অনুমতি নেওয়ার সময়েই। পুজোয় যে বর্জ্য বেড়ে যায় তা মেনে নিচ্ছেন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্রও। তিনি বলছেন, ‘‘আমরা সব সময়ই পুজো কমিটিগুলিকে প্লাস্টিক বর্জন করতে বলি। কিন্তু প্লাস্টিকমুক্ত পুজো করতে হবে সেই আইনি ক্ষমতা আমাদের নেই। আদালত নির্দেশ দিলে তা হতে পারে।’’
কার দায়, কে সামলাবে তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকে। এর মাঝে পুজো আসে, পুজো যায়, পড়ে থাকে শালপাতা। থুড়ি প্লাস্টিক!