দগদগে: দেওয়ালে চিহ্নিত করা হয়েছে গুলির দাগ। ছবি: শান্তনু ঘোষ।
নিরস্ত্র জনতার উপরে গুলি চালানোর নির্দেশ দিলেন জেনারেল ডায়ার। দিনটা ছিল ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল। অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ। জনতার হাতে লাঠি ছাড়া কোনও অস্ত্র নেই। তাঁরা নিরস্ত্র অবস্থায় প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্রোহী ভারতীয়দের ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্যই গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে দেন ডায়ার। ছোট্ট একচিলতে জায়গায় আটকে পড়া প্রতিবাদীদের উপরে ৮ থেকে ১০ মিনিট ধরে চলল এই গুলিবর্ষণ, গুলি চালানো বন্ধ হল কেবল গুলির জোগান শেষ হওয়ার মুখে! প্রাণ বাঁচাতে কেউ পাগলের মতো এ দিক-ও দিক ছোটাছুটি শুরু করে দেন, কেউ বা ঝাঁপিয়ে পড়েন ওখানকার কুয়োতেই। তাতেও রক্ষা পাওয়া যায়নি!
জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই কুয়ো এ বার তৈরি হতে চলেছে এ শহরে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ শহিদের সেই কুয়ো, ‘মার্টারস ওয়েল’ তৈরি করতে চলেছেন। আগামী অগস্ট থেকে ওই কুয়ো তৈরির কাজ শুরু করা হবে। এখন ওই কুয়োর নকশা, সে সম্পর্কে গবেষণা, তার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে জালিয়ানওয়ালাবাগ নিয়ে যে সব ইতিহাসবিদ কাজ করেছেন, তাঁদের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করা হচ্ছে। শুধু তাঁদেরই নয়, জালিয়ানওয়ালাবাগে যাঁরা শহিদ হয়েছিলেন, সেই শহিদের পরিবারেরও সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সে কাজ করার জন্য এক বিশেষ প্রতিনিধিদলের দিল্লি, অমৃতসরে যাওয়ার কথা। ‘প্রতীকী’ ওই কুয়োটি ভিক্টোরিয়ার ‘পোট্রেট গ্যালারি’তে ফেব্রিক ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা হবে। সেই ‘ইনস্টলেশন আর্ট’-এর কাজ আগামী নভেম্বরে শেষ হওয়ার কথা বলে জানাচ্ছেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ।
এমনিতে চলতি বছরের শুরু থেকেই ঘটনার একশো বছর পূর্তি উপলক্ষে নানা স্মরণ-অনুষ্ঠান, আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে ইতিহাসের সেই ‘কালো অধ্যায়’-এর কথা। গোপালকৃষ্ণ গাঁধী এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘যদি কোনও একটি ভূমিখণ্ড, কোনও একটা স্থান, ইতিহাস বদলে দেওয়ার প্রতীক হয়ে উঠে থাকে, তো সেটা হল জালিয়ানওয়ালা।’ জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা তো শুধুই ১৩ এপ্রিলে সীমাবদ্ধ ছিল না। সে ঘটনার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
দগদগে: শিল্পীর তুলিতে সে দিনের হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য। ছবি: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে
জালিয়ানওয়ালাবাগ-হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গর্জে উঠল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলম। ১৯১৯ সালেই ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নাইটহুড উপাধি ত্যাগ করে বড়লাট চেমসফোর্ডকে লিখলেন ঐতিহাসিক প্রতিবাদলিপি। লিখলেন, ‘‘...অ্যান্ড দিজ় আর দ্য রিজ়িনস হুইচ হ্যাভ পেনফুলি কমপেলড মি টু আস্ক ইওর এক্সিলেন্সি টু রিলিভ মি অব মাই টাইটেল অব নাইটহুড..’’। কবি নিজেই ওই চিঠির বঙ্গানুবাদ করেছিলেন,—‘কয়েকটি স্থানীয় হাঙ্গামা শান্ত করিবার উপলক্ষে পানজাব গবরনমেনট যে সকল উপায় অবলম্বন করিয়াছেন, তাহার প্রচণ্ডতায় আজ আমাদের মন কঠিন আঘাত পাইয়া ভারতীয় প্রজাবৃন্দের নিরূপায় অবস্থার কথা স্পষ্ট উপলব্ধি করিয়াছে।...’।
ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় বলেন, ‘‘জালিয়ানওয়ালাবাগ-হত্যাকাণ্ড শুধু শোকের ছিল না, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে তা ছিল অপমানেরও। তাই তিনি চাননি যে দেশের ও জাতির অপমানকে চিরস্থায়ী করার জন্য কোনও স্মারক তৈরি করা হোক সেখানে। যদিও সেখানে (জালিয়ানওয়ালাবাগ) একটা স্মারকচিহ্ন তোলা হয়েছে। কিন্তু সেটা গুরুদেবের অনভিপ্রেত ছিল। তিনি তার প্রতিবাদ করেছিলেন।’’
ইনস্টলেশন আর্টের নকশা। ছবি: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে
সেই সমস্ত প্রতিবাদচিহ্ন, জালিয়ানওয়ালাবাগ নিয়ে নানা ভাষায় যে সমস্ত কবিতা, গান রচিত হয়েছে, সে সমস্ত কিছুও দেখতে-শুনতে পাওয়া যাবে ভিক্টোরিয়ার ওই ‘ইনস্টলেশন আর্ট’-এ। জালিয়ানওয়ালাবাগ নিয়ে, সে সময়ে কাগজে যা যা লেখা হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যা লিখেছিলেন, সবই দেখতে পাবেন দর্শকেরা। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কিউরেটর সেক্রেটারি জয়ন্ত সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘পেপার অবজেক্টের পাশাপাশি অডিয়ো-ভিসুয়ালও থাকবে। এমন ভাবে বিষয়টি করা হচ্ছে যেন আপনি ওই কুয়োর দিকে যাচ্ছেন, আর সেই শোক, স্মৃতি আপনাকে ঘিরে ধরছে।’’