প্রতীকী চিত্র।
ভাগাড়-কাণ্ডের ছায়া কি এ বার ভুয়ো প্রতিষেধক চক্রেও? ধৃত দেবাঞ্জন দেবকে ঘিরে তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই যেন বছর চারেক আগে ঘটে যাওয়া ভাগাড়-কাণ্ডের ছায়া প্রকট হচ্ছে তদন্তকারীদের মনে। সে ক্ষেত্রে মানুষের অজানতেই মরা পশুর মাংস ঢুকেছিল তাঁদের দেহে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষেধকের নামে ঢুকেছে অন্য কোনও তরল। এই ঘটনায় খোদ মুখ্যমন্ত্রী খুনের চেষ্টার ধারা যুক্ত করার পক্ষে জানার পরে পুলিশও সেই মতো ব্যবস্থা নিয়েছে। আইনজীবীদের বড় অংশও ভাগাড়-কাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে ওই ধারা যুক্ত করার পক্ষেই মত দিয়েছেন।
২০১৮ সালের এপ্রিলে হঠাৎ শোরগোল পড়ে গিয়েছিল ভাগাড়ের মাংস নিয়ে। তদন্তে জানা যায়, মৃত পশুর মাংস কেটে তা রাখা হত এ শহর এবং রাজ্যের বেশ কিছু হিমঘরে। মাংস রাখতে ব্যবহার করা হত অ্যালুমিনিয়াম সালফেট, লেড সালফেট, ফরম্যালিনের মতো রাসায়নিক। এর পরে ওই মাংস একটি বাক্সে ভরে তার উপরে ইলিশ বা চিংড়ি মাছ রেখে পাচার করা হত একাধিক প্রতিবেশী রাজ্যে। শহরের একাধিক রেস্তরাঁর পাশাপাশি যা যেত বিভিন্ন শপিং মলে ‘ফ্রোজ়েন’ মাংস হিসেবে। এই কারবার চলছিল টানা দশ বছর। তার পরে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয় দু’জনকে। শেষে মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয় রাজ্যের নানা জায়গা থেকে।
শহরের মধ্যে নারকেলডাঙা ও মানিকতলার হিমঘর এই চক্রের মূল ঘাঁটি বলে সামনে আসে। ঘটনার তদন্তভার যায় সিআইডি-র হাতে। সর্বত্র এই ভেবে আতঙ্ক ছড়ায় যে, যে সমস্ত পশুর মাংস এ ক্ষেত্রে অজানতেই মানুষের শরীরে ঢুকেছে, সেই সব পশুর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অজানা। কোনও রকম বিষক্রিয়া থেকে এমন পশুর মৃত্যু হয়ে থাকলে, সেই মাংস মানুষের শরীরে ঢুকলে কী হতে পারে, তা ভেবেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন অনেকে।
ওই ঘটনার মতোই এখন আতঙ্ক ছড়িয়েছে ভুয়ো প্রতিষেধক শরীরে ঢোকা নিয়ে। প্রতিষেধক হিসেবে যে তরল দেওয়া হয়েছে, তা আদতে কী, সেটা ফরেন্সিক পরীক্ষার রিপোর্ট আসার আগে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ভাগাড়-কাণ্ডের মতো এ ক্ষেত্রেও গোটা বিষয়টির পিছনে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য কাজ করেছে বলে পুলিশি তদন্তে উঠে আসছে। তবে ভাগাড়-কাণ্ড ছিল আরও ব্যাপক। আর প্রতিষেধক দুর্নীতির এই ঘটনা আপাতত শহর ও শহরতলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য দু’টি ঘটনার মধ্যে তফাত করতে নারাজ। তাঁর দাবি, “কোনও মানুষের দেহে কোন ধরনের ওষুধ, প্রোটিন বা খাদ্য যাওয়া উচিত, তা এক জন
চিকিৎসক বা ডায়েটেশিয়ান ঠিক করতে পারেন। ফলে, পচা মাংস যেমন শরীরে ঢোকানো অপরাধ, তেমনই অপরাধ প্রতিষেধকের নামে অজানা তরল ঢোকানো।” তাঁর আরও দাবি, “এটি নিছক প্রতারণার ঘটনা নয়। ভাগাড়-কাণ্ডে দেওয়া না-হলেও এ ক্ষেত্রে অবশ্যই হত্যার চেষ্টার ধারায় মামলা রুজু হওয়া উচিত। ভাগাড়-কাণ্ড দেখার পরে পুলিশেরই উচিত ছিল, এ নিয়ে বাড়তি সতর্ক হওয়া।”
ভাগাড়-কাণ্ডের চার্জশিটে শেষ পর্যন্ত যে সাত জনের নাম ছিল, তারা প্রত্যেকেই এখন জামিনে মুক্ত। এক সময়ে ৯০ দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ চার্জশিট দিতে
না-পারায় তাদের জামিন হয়ে যায়। ওই সময়ে পুলিশের ব্যাখ্যা ছিল, বেলগাছিয়ার ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি ভাগাড়ের মাংসের পরীক্ষার রিপোর্ট পেশ করতে পারেনি। নমুনা এতটাই পচে গিয়েছিল যে, তা পরীক্ষা করা যায়নি। আবার পচা মাংস কিনেছেন, এমন কোনও অভিযোগকারীর সন্ধানও পাওয়া যায়নি। কারণ, ওই মাংস যে বা যাঁরা কিনেছেন, তাঁরাও পচা মাংসের কারবারের সঙ্গে যুক্ত ধরে নিয়ে অভিযুক্ত হবেন। সেই ভেবেই কেউ সামনে আসেননি। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৭২, ২৭৩ এবং ১২০বি ধারায় রুজু হওয়া ভাগাড়-কাণ্ডের মামলার বিচার চলছে। ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবী দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, “প্রতিষেধক মামলাতেও খুনের চেষ্টার ধারা রাখা মুশকিল। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তের স্বার্থসিদ্ধির কোনও গুরুতর ‘মোটিভ’ পুলিশ এখনও জোগাড় করে উঠতে পারেনি।”