পুনর্মিলন: পরিবারের সঙ্গে সুরেশ গোবিন্দ কাম্বলে (নীল জামা)। পাশে নিহাল খান। খিদিরপুরে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
গৃহহীন সুরেশ গোবিন্দ কাম্বলের আশ্রয়দাতা নিহাল খান। এই শহরে। মহারাষ্ট্রের মিরজ গ্রামের বাসিন্দা সুরেশকে খিদিরপুরের অলিগলি চেনে আবদুল্লা নামে। মানবতার ধর্মে ‘দীক্ষিত’ বছর ষাটের প্রৌঢ়ের কোনও পরিচয়েই আপত্তি নেই। বলেন, ‘‘নামে কী আসে যায়?’’ আসে যায় না বলেই তিরিশ বছর পরে সুরেশের সন্ধান পেয়ে নিহাল খানকে বুকে টেনে নেয় কাম্বলে পরিবার।
সালটা ১৯৮৯। মুম্বইয়ের বেসরকারি হাসপাতালে এক্স-রে টেকনিশিয়ানের কাজ করতেন সাংলি জেলার মিরজ গ্রামের সুরেশ। হঠাৎ এক দিন কাজ চলে যায়। বাড়িতে স্ত্রী বিমলা কাম্বলের পাশাপাশি তখন দুই কোলের সন্তান। বড় ছেলে মিঠুনের মাত্র তিন বছর বয়স। সদ্যোজাত মেয়ে সুপ্রিয়ার দু’মাস। এই পরিস্থিতিতে চাকরির খোঁজে বিভিন্ন শহরে ঘোরা শুরু করেন সুরেশ। জানালেন, কোথাও চাকরি না পাওয়ায় হতাশা ছিলই। এর উপরে শিক্ষাগত যোগ্যতার সব শংসাপত্র চুরি হয়ে গেলে দিশাহারা হয়ে পড়েন তিনি। মুম্বই, গুজরাত, বিহার ঘুরে ২০০৬ সাল নাগাদ এসে পৌঁছন কলকাতার খিদিরপুরে।
নিহাল জানান, তাঁর দোকানের সামনে দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত ছিল সুরেশের। উস্কোখুস্কো চুল, গায়ে মলিন পোশাক। কারও সঙ্গে বাক্যালাপ নেই। নাম জিজ্ঞাসা করলে জানান, তিনি আবদুল্লা। সেই থেকে প্রতিদিন দোকানে বসিয়ে আবদুল্লাকে খাবার খাওয়াতেন নিহাল। নিজের দোকানের গুদামে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেন। সেই সম্পর্ককে ‘চাচাজি ও ভাইজান’-এর সুতোয় বেঁধে ফেলার সঙ্কল্প নেয় চেতলার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
২০০৭ সালে খিদিরপুরে জঞ্জালের স্তূপে আবদুল্লার হদিস পান ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিরা। বিড়বিড় করে কোরান পাঠ করছেন। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিরা তাঁর আপনজন সম্পর্কে জানতে চাইলে আবদুল্লা বলেন নিহালের কথা। সুরেশের কথায়, ‘‘কোথাও কেউ কাজ দেয়নি। নিহাল চাচাজি আমাকে দোকানে বসিয়ে খাবার খাওয়াতেন। মাজার, মসজিদে অনেক রাত কাটিয়েছি।’’ এর পরে নিহালের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিরা তাঁকে বোঝান, ভিন্ রাজ্যের অতিথির চিকিৎসা প্রয়োজন। সুরেশকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ায় জানা যায়, তাঁর মধ্যে স্কিৎজ়োফ্রেনিয়ার লক্ষণ স্পষ্ট। তবে চিকিৎসায় ধীরে ধীরে অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। তার পরে জানা যায়, আবদুল্লাই আদতে সুরেশ।
বছর ছ’য়েক আগের সেই ঘটনার পরেও ‘চাচাজি-ভাইজান’-এর সম্পর্কে কোনও বদল আসেনি। ইদে সিমুই এবং গণেশ চতুর্থীর লাড্ডু— হাসিমুখে দুইয়েরই স্বাদ নিয়েছেন সুরেশ ওরফে আবদুল্লা। নিহাল জানান, বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলে সুরেশ অভিমানী হয়ে উঠতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, এত দিন পরে তিনি সন্তানদের বোঝা হতে চান না। নিহালের দোকানে সকাল আটটা থেকে রাত দশটার রোজনামচায় বেশ আছেন। ‘ভাইজান’-এর এমন অনড় মনোভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন নিহাল। ঘটনাচক্রে এ সব ঘটনা যেখানে ঘটেছে, খিদিরপুরের সেই এলাকার নাম ‘অরফ্যান (অনাথ) গঞ্জ’।
এ সবের মধ্যেও সুরেশের পরিবারকে খুঁজে পাওয়ার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছিল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি। সুরেশ এক সময়ে যে হাসপাতালে কাজ করতেন, তাদের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। সেই যোগাযোগ অবিকল সিনেমার মতো। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিদের থেকে সুরেশের কাহিনি জেনে দু’টির মধ্যে একটি হাসপাতালের নার্সিং সুপার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সুরেশের ছবি পোস্ট করেন। ঘটনাচক্রে, ওই হাসপাতালেই নার্সের কাজ করেন সুরেশের মেয়ে সুপ্রিয়া। দিন সাতেক আগে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বাবার ছবি দেখে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি এবং ভাই মিঠুন। একত্রিশ বছর পরে বাবার কাঁধে হাত রেখে মেয়ে বলেন, ‘‘তুমি বোঝা নও। মাথার উপরে তুমি আছ, এই অনুভূতিটা খুব জরুরি।’’
মিলনের সেই মুহূর্তে সুরেশ বলেন, ‘‘আমি আবদুল্লা না সুরেশ, সেই ভাবনা কখনও বিচলিত করেনি। ভালবাসাই তো আসল।’’ আর নিহালের কথায়, ‘‘মানুষের মধ্যে ভালবাসা থাকলে মনুষ্যত্বের জন্য বাঁচবে। ধর্ম-জাতির জন্য কেউ বাঁচে না।’’
সব শুনে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার সর্বাণী দাস রায় বলছেন, ‘‘অনেকেই আবদুল্লাদের পাগল বলে দেগে দেন। কিন্তু এই মানুষগুলোই পাঠ দেন মনুষ্যত্বের।’’
এই প্রতিক্রিয়ার ফাঁকেই হাতে হাত রেখে দুই প্রৌঢ় পরস্পরকে বললেন, ‘‘ভাল থাকুন। খুব মন খারাপ করলে চলে আসবেন।’’
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।