স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেই যদি নজর দেওয়া যায়, দেখা যাবে, রূপান্তরকামীদের জীবনযাপনের ধরন একাধিক রোগের কারণ। প্রতীকী ছবি।
ওঁরা এ দেশের নাগরিক। ভোটও দেন। তবু, দেশের কোনও পুরুষ বা মহিলা নাগরিকের সমতুল সুবিধা পেতে আজও প্রতীক্ষায় ওঁদের গোটা সম্প্রদায়। ঠিক ন’বছর আগে ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল নালসার রায়ে রূপান্তরকামী (ট্রান্সজেন্ডার) তথা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য সমান নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এর পরেও বদলায়নি পরিস্থিতি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চাকরির মতো জরুরি পরিষেবা পেতে এখনও সেই হাপিত্যেশ।
রূপান্তরকামীদের সংগঠনের নেতৃত্বের আফশোস, তাঁদের নিয়ে কোনও সমীক্ষা করেনি সরকার। ফলে, সমস্যার দিকগুলো তুলে ধরা বা সমাধানের রাস্তা খোঁজার কাজও বিশ বাঁও জলে। শুধু স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেই যদি নজর দেওয়া যায়, দেখা যাবে, তাঁদের জীবনযাপনের ধরন একাধিক রোগের কারণ। কিন্তু, রোগের প্রকৃতি অথবা আক্রান্তের সংখ্যা কত? জানেন না কেউ।
‘হেড অ্যান্ড নেক’ ক্যানসার শল্য চিকিৎসক সৌরভ দত্ত বলছেন, “রূপান্তরকামীদের অনেকেই অতিরিক্ত ধূমপান, গুটখা সেবন, মদ্যপান, বিভিন্ন ধরনের নেশা এবং যৌনতার প্রতি আকৃষ্ট হন। এর ফলে ফুসফুস, মুখ, যকৃৎ ও মলদ্বারে ক্যানসারের প্রবণতা বাড়ে। কিন্তু, এই সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য বা গবেষণার রিপোর্ট আমাদের কাছে নেই।” ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় এবং সৌরভ দত্ত, উভয়েই জানাচ্ছেন, আরও এক ধরনের ক্যানসারের প্রকোপ দেখা যায় রূপান্তরকামীদের মধ্যে। তা হল ওভোটেসটিস। আপাতদৃষ্টিতে কোনও নারী, যাঁর ডিম্বাশয় (ওভারি) রয়েছে, আবার শরীরের ভিতরেই রয়ে গিয়েছে শুক্রাশয় (টেস্টিস)। সেই অংশে এঁদের কারও কারও ক্যানসারে আক্রান্ত টিউমার দেখা যায়।
তবে, সামাজিক লজ্জা ও অর্থনৈতিক টানাপড়েন— এই দুইয়ের কারণে রূপান্তরকামী পুরুষ ও নারীদের চিকিৎসার ক্ষেত্র যে অনেকটাই সঙ্কুচিত, তামানছেন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রান্সজেন্ডার হিজড়ে ইন বেঙ্গল’-এর কর্ণধার রঞ্জিতা সিংহ। তাঁর মতে, ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায় সম্পর্কে সরকারের কাছে বিস্তারিত তথ্য না থাকাটা কোনও প্রকল্পের সূচনা, সচেতনতার প্রচার বা গবেষণামূলক কাজের অন্তরায় হয়ে রয়েছে। অথচ, প্রতিবেশী রাজ্যঝাড়খণ্ড, বিহার বা ওড়িশায় ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য সরকার কিছুটা হলেও ভাবে। সেখানে নথিভুক্ত ট্রান্সজেন্ডারদের কোথাও অতিরিক্ত রেশন, কোথাও জমি, কোথাও বা চাকরির ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সুবিধা, এমনকি, ‘সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট’ অস্ত্রোপচারের জন্যদু’-আড়াই লক্ষ টাকা দিয়ে থাকে রাজ্য সরকার।
‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস’-এর সদস্য, ওড়িশার বাসিন্দা মীরা পারিদা জানাচ্ছেন, তাঁর রাজ্যে নথিভুক্ত ট্রান্সজেন্ডারদের মাসিক পাঁচশো টাকা পেনশন, ৩৫ কিলোগ্রাম চাল, সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে পৃথক লাইনের সুবিধা আছে। সম্প্রতি বিজ্ঞপ্তি এসেছে, পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর পদে চাকরির জন্য যোগ্যতা অর্জনের পরীক্ষায় তাঁরা বসতে পারবেন। পাশাপাশি, বেশ কিছু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নিজেদের পরিচয় সমেত তাঁরা যাতে বসতে পারেন, তার জন্য নতুন করে ফর্ম তৈরি করছে ওড়িশা সরকার।
এ বার পশ্চিমবঙ্গের এই অচলায়তন ভাঙতে এগিয়ে এল শহরে পরিষেবা দিতে শুরু করা একটি বেসরকারি হাসপাতাল। ১৫ এপ্রিল দিনটিকে নিজেদের ‘জাতীয় দিবস’ হিসাবে পালন করেন রূপান্তরকামীরা। তাই এই দিনটিকেই বেছে নিয়েছিল ‘এইচসিজি ইকো ক্যানসার সেন্টার, কলকাতা’। রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের কাছে বিশেষ চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দিতে শুরু হল ‘এইচসিজি প্রাইড অ্যান্ড প্রিভিলেজ কার্ড’। শনিবার আইসিসিআর-এ আয়োজিত সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার আমেরিকান কনসাল জেনারেল মেলিন্ডা পাভেক, মুনমুন সেন, অগ্নিমিত্রা পাল, রঞ্জিতা সিংহ-সহ অনেকে।
হাসপাতালের তরফে অমরজিৎ সিংহ বলেন, ‘‘প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময়েই বঞ্চিত হন রূপান্তরকামী মানুষেরা। সকলের জন্য স্বাস্থ্য, এই মনোভাব থেকেই আমরা তাঁদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। এই কার্ডের মাধ্যমে ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা বিনামূল্যে করানো যাবে। এ ছাড়া, হাসপাতালে ভর্তি এবং বহির্বিভাগে দেখানোর ক্ষেত্রেও তাঁদের জন্য ছাড়ের ব্যবস্থা থাকবে।’’
এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে উৎসাহিত রূপান্তরকামীদের সংগঠনের সদস্যেরা। তাঁদের আশা, রূপান্তরকামীদের জন্য আগামী দিনে সরকারি এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে অনেকে এগিয়ে এলে বঞ্চনার একটা ধাপ কমবে।