রাস্তার খাবার হোক পরিচ্ছন্ন, পাঠ দিলেন ডেনমার্কের স্বেচ্ছাসেবীরা

খাবারের শহর, নাকি শহরের খাবার! মহানগরের আনাচ-কানাচে পা রেখে এমনটাই মনে হয়েছিল ড্যানিশ যুবক ম্যাটিয়াস পোলম্যান গোমেজের। ডেনমার্কের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী তিনি। সারা শহরে রাস্তার খাবারে এত বৈচিত্র্য, দোকানে দোকানে এত মানুষের কর্মসংস্থান, এত মানুষ এত সস্তায় খাওয়াদাওয়া করেন— দেখে রীতিমতো বিস্মিত তিনি। কেবল মনে হয়েছিল, আর একটু যদি পরিচ্ছন্ন হতো দোকানগুলো! দোকানের কর্মীরা যদি আর একটু সচেতন হতেন।

Advertisement

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৭ ০২:২৬
Share:

মাথায় টুপি, গায়ে অ্যাপ্রন। চলছে পরিবেশন। — নিজস্ব চিত্র

খাবারের শহর, নাকি শহরের খাবার! মহানগরের আনাচ-কানাচে পা রেখে এমনটাই মনে হয়েছিল ড্যানিশ যুবক ম্যাটিয়াস পোলম্যান গোমেজের। ডেনমার্কের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী তিনি। সারা শহরে রাস্তার খাবারে এত বৈচিত্র্য, দোকানে দোকানে এত মানুষের কর্মসংস্থান, এত মানুষ এত সস্তায় খাওয়াদাওয়া করেন— দেখে রীতিমতো বিস্মিত তিনি। কেবল মনে হয়েছিল, আর একটু যদি পরিচ্ছন্ন হতো দোকানগুলো! দোকানের কর্মীরা যদি আর একটু সচেতন হতেন।

Advertisement

মনে হওয়ারই অপেক্ষা শুধু। ডেনমার্কের ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাই এগিয়ে এল, হাত মেলাল এ রাজ্যের আরও দু’টি সংস্থার সঙ্গে। শুরু যৌথ কর্মসূচি, ‘স্ট্রিট ফুড প্রোজেক্ট কলকাতা’। প্রোজেক্টের প্রধান সুদীপ বর্মণ জানালেন, স্ট্রিট হকারদের আইনি মান্যতা আগেই দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এই ব্যবসায়ীদের জন্য রয়েছে ‘ন্যাশনাল পলিসি ফর আরবান স্ট্রিট ভেন্ডর’। ২০১৪ সালে সরকারি অ্যাক্টও চালু হয়েছে। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা, ন্যূনতম শিক্ষা আর পর্যাপ্ত আধুনিক সরঞ্জামের অভাবে কোনও ব্যবস্থাই রূপায়িত হচ্ছে না। ‘‘ডেনমার্কের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ইনোএইড’ এ বিষয়ে প্রস্তাব রাখার সঙ্গে সঙ্গেই একমত হই আমরা। কাজ শুরু হয় দ্রুত,’’ বললেন সুদীপ।

‘ইনোএইড’ প্রথম কাজ শুরু করে সল্টলেক সেক্টর ফাইভের খাবারের ব্যবসায়ীদের নিয়ে। পরে সারা শহরের আরও নানা জায়গায় হাজার খানেক স্ট্রিট ফুড হকারকে নিয়ে কর্মশালা করিয়ে পরিচ্ছন্নতার পাঠ শেখানো হয়। প্রাথমিক ভাবে খুব ছোট কিছু বিষয়ে সচেতন করা হয় ব্যবসায়ীদের। যেমন, রান্নার বা খাওয়ার জল ড্রাম থেকে তুলতে হাত ডোবানো মগের বদলে ট্যাপকলের ব্যবস্থা করতে বলা হয়। বলা হয় দোকানের বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ অনুযায়ী ঠিক মাপের ডাস্টবিন রাখতে, যাতে তা উপচে পথঘাট নোংরা না হয়। রান্না ও পরিবেশনের সময়ে কর্মীদের অ্যাপ্রন পরা ও মাথা ঢাকা, খাবার দেওয়ার সময়ে হাতের বদলে চিমটে ব্যবহার করার কথাও ওঠে তাতে।

Advertisement

পাঁচ বছর ধরে দফায় দফায় ওই কাজ চালানোর পরে প্রোজেক্টের সুদীপবাবুর পর্যবেক্ষণ, কর্মশালায় ভাল সাড়া মিললেও, খাতা-কলম থেকে বাস্তবে ফিরলেই ছবিটা বদলে যাচ্ছিল। ব্যবসায়ীদের প্রাথমিক প্রশ্ন ছিল, ‘কেন করব এ সব! আমাদের কি লাভ বাড়বে?’ তবে শেষ পর্যন্ত তাঁদের বোঝানো সম্ভব হয়েছে, পরিচ্ছন্নতার খাতে সামান্য বিনিয়োগ করলে তা ব্যবসার জন্যই লাভজনক। ঠিক যেমনটা বুঝেছেন সল্টলেকের ব্যবসায়ী কৃষ্ণা সরকার। টেকনো ইন্ডিয়ার সামনে রুটি-পরোটা-মাংস-ফ্রায়েড রাইসের দোকান তাঁর। দুপুরে পা ফেলার জায়গা থাকে না খদ্দেরের চাপে।

কৃষ্ণা জানালেন, আগে ভাবেননি, রাস্তার ধারে এ রকম দোকান চালানোর জন্য পরিচ্ছন্নতার দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। জেনেও ভেবেছিলেন, রাস্তার দোকানের জন্য এত কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু এখন কৃষ্ণার কথায়, ‘‘খাবারটুকু যত্ন করে রাঁধাই শুধু নয়, পরিবেশনেরও পদ্ধতি আছে। নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাও খাবারের স্বার্থেই জরুরি। ওই স্যার-ম্যাডামেরাই হাতে ধরে শিখিয়েছেন।’’ মাথার টুপি ঠিক করে নিয়ে বললেন অ্যাপ্রন পরা কৃষ্ণা।

একই বক্তব্য লেকমার্কেট এলাকায় দক্ষিণী খাবারের পসরা-গাড়ি নিয়ে বসা আনি আপ্পানের। বললেন, ‘‘আগে যেমন-তেমন করে খাবারটা বিক্রি করতাম কেবল। এখন আমি নিজে অ্যাপ্রন পরি, খদ্দেরদের জন্য পেপার ন্যাপকিন রাখি। ডাস্টবিন বদলেছি। ডিসপোজেবল থালার ব্যবহার শুরু করেছি। আগে মনে হতো, এ সবে ফালতু খরচ করছি। কিন্তু এখন বুঝি, সামান্য চেষ্টায় দোকানের চেহারাটাই বদলে গিয়েছে। আমার খদ্দেরদের অনেকেই রাস্তার দোকানে খেতে চান না। কিন্তু আমার কাছে আসতে অসুবিধা নেই তাঁদের। এটাই এই শিক্ষার প্রাপ্তি।’’

প্রোজেক্টের মূল উদ্যোক্তা ডেনমার্কের ‘ইনোএইড’ সংস্থার প্রেসিডেন্ট মেরি লুইস লারসেন জানালেন, ‘‘আমাদের উদ্যোগটা যে এতটা সফল হবে, ভাবতেও পারিনি। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্য না পেলে এবং ব্যবসায়ীরা নিজেরা সহযোগিতা না করলে এত দূর এগোতে পারতাম না। ভবিষ্যতে আরও করব এ ধরনের কাজ।’’ এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষও। তিনি বলেন, ‘‘শহরের স্ট্রিট ফুড ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে দীর্ঘ দিন ধরেই নানা রকম অভিযান চালিয়েছি আমরা। এ কাজে হাত লাগাতে চাইলে যে কোনও রকম উদ্যোগই স্বাগত।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement