এসএসকেএমের ঘটনায় নিজের অবস্থান থেকে সরলেন না মদন মিত্র। ফাইল চিত্র।
এসএসকেএমকাণ্ডে নিজের অবস্থানে অনড় তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্র। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর নাম না করলেও যে ভাবে তাঁর বিরুদ্ধে ‘গুন্ডামি’ ইত্যাদির অভিযোগ এনেছেন, তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রাক্তন মন্ত্রী তথা কামারহাটির বিধায়ক শনিবার সাংবাদিক বৈঠক ডেকে বিধায়ক পদ ছেড়ে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন! বস্তুত, মদনের ওই হুমকির আওতায় তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আছেন। কারণ, নাম না করলেও তাঁকে লক্ষ্য করেই মদন বলেছেন, ‘‘দরকার পড়লে পদ ছেড়ে দেব। একটা তো বিধায়ক পদ। আমি সোনালি গুহ, শুভেন্দু অধিকারী, দীনেশ ত্রিবেদী বা মুকুল রায় নই। আমি মদন মিত্র! উনি আমাকে কী দিয়েছেন?’’ মদন জানান, দলের পদ ছেড়ে দিতে হলে তিনি টিউশনি করে পেট চালাবেন। বলেছেন, ‘‘ওই তো বিধায়কের মাইনে! যদি ছেড়ে দিতে বলেন, ছেড়ে দেব! তেমন হলে রাজনীতিই ছেড়ে দেব! দরকার হলে টিউশনি করে পেট চালাব। যা পড়াশোনা আছে, তাতে মাসে বিশ-তিরিশ হাজার টাকা পেয়ে যাব।’’ তেরিয়া মেজাজে সাংবাদিক বৈঠক করলেও মদন একটি অনুরোধ করেছেন। বলেছেন, তাঁর পরিবারের কারও প্রতি যেন ‘প্রতিহিংসামূলক আচরণ’ না করা হয়। আরও একটি অনুরোধ করেছেন মদন। বলেছেন, ‘‘(বিধায়ক পদ থেকে) পদত্যাগের এক মাসের মধ্যে ভোট করাবেন। আমি নির্বাচিত কামারহাটি থেকে। আমায় তৃণমূল জেতায়নি। তৃণমূল জোড়াফুল প্রতীক দিয়েছে। কিন্তু জিতিয়েছে কামারহাটির জনতা।’’
পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে মদনের ক্ষোভ প্রশমনে ময়দানে নেমেছে তৃণমূল। দলের তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ জানিয়েছেন, তিনি শনিবারই মদনের সঙ্গে কথা বলবেন। কুণালের কথায়, ‘‘কাল (শুক্রবার) রাতের ঘটনায় হয়তো মদন’দা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ওঁর মাথা ঠান্ডা হলে অবশ্যই কথা বলা যাবে। পিজি হাসপাতাল তো মদন’দাই সুন্দর করে সাজিয়েছেন। আর সিপিএম জমানায় পিজি হাসপাতালে যে দালালরাজ তৈরি হয়েছিল, তা-ও ভেঙেছিলেন মদন’দাই।’’ কুণালের আরও বক্তব্য, ‘‘মদন’দা কোনও ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। শক্ড হয়েছেন। হাসপাতালে বিশৃঙ্খলা যেমন বরদাস্ত করা হবে না, তেমনই এটাও ঠিক যে, যদি শীর্ষস্থানীয় কেউ তাদের গাফিলতি আড়াল করতে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিযে মদন’দার ঘাড়ে দোষ দিয়ে থাকেন, সেটাও ঠিক নয়।’’
মদন অবশ্য কুণালকেও ছাড়েননি। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র সম্পর্কে মদনের বক্তব্য, ‘‘ওঁর বিরুদ্ধে তো সাড়ে চারশো মামলা আছে। লঙ্কাধীশ স্বামী মোর, পুত্র মেঘনাদ, আমি কি ডরাই সখি, ভিখারী রাঘবে!’’
ঘটনার সূত্রপাত শুক্রবার রাতে। এসএসকেএম হাসপাতালে এক দুর্ঘটনাগ্রস্ত যুবককে ভর্তি নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছিলেন মদন। শুভদীপ পাল নামে ওই যুবক নিজেও স্বাস্থ্যকর্মী বলে মদনের দাবি। তাঁকেই ভর্তি করাতে মদন এসএসকেএমে যান। কিন্তু তাঁকে হাসপাতাল ভর্তি নেয়নি বলে মদনের অভিযোগ। সেখানে দাঁড়িয়েই মদন বলেন, দরকার হলে তিনি নিজের ঘড়ি-আংটি বিক্রি করে ওই যুবকের চিকিৎসা করাবেন। এমনও বলেছিলেন যে, সিপিএমের আমল হলে তিনি এক মিনিটে ওই যুবককে ভর্তি করিয়ে দিতে পারতেন! হাসপাতালের বিরুদ্ধে দালালরাজের অভিযোগ তুলে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের দাবিও করেন। কিন্তু ওই যুবককে ভর্তি নেওয়া হয়নি। বরং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শনিবার সাংবাদিক বৈঠক করে পাল্টা ‘গুন্ডামি’র অভিযোগ করেন। এসএসকেএমের ডিরেক্টর জানিয়ে দেন, শনিবার সকালে ওই বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। এ বিষয়ে ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি নেওয়ার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রীও। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, শুক্রবার রাতে হাসপাতালের চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের হেনস্থা করা হয়েছে। মদনের নাম না করলেও তাঁকেই যে ‘বার্তা’ দেওয়া হয়েছে, তা বুঝে নিতে মদনের অসুবিধা হয়নি।
এর পরেই মদন পাল্টা জানান, এসএসকেএমের ট্রমা কেয়ার সেন্টারে রাজ্যের প্রতিটি সাধারণ মানুষ চিকিৎসা পরিষেবা পেতে বাধ্য। মদনের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের হেনস্থা করা যাবে না! আমি ওঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। যিনি গতকাল (শুক্রবার) আহত হয়েছিলেন, তিনিও স্বাস্থ্যকর্মী। তাঁর পাশে দাঁড়াতেই আমি এসএসকেএমে গিয়েছিলাম। এতে যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তা হলে আমায় তাড়িয়ে দিন! চলে যাব। যা বলবেন মেনে নেব।’’ শুক্রবার রাতে এসএসকেএমে দাঁড়িয়ে হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাদের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন মদন। শনিবার দুপুরেও একই দাবি তুলেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা কেন সাসপেন্ড হবেন না? দুর্ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ট্রমা কেয়ারে সকলের জায়গা পাওয়ার কথা। মোদীর (প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী) বাপের বাড়ির কেউ আহত হয়ে এলেও ভর্তি করতে হবে! এটা পিজি হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার সেন্টার।পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ট্রমা কেয়ার সেন্টার। কারও বাপের ট্রমা কেয়ার সেন্টার নয়! ওই ট্রমা কেয়ার সেন্টারে বাংলার মানুষের ঘাম-রক্ত লেগে আছে! অথচ ওই রোগীকে না দেখেই ওঁরা বলে দিয়েছিলেন, ভর্তি নেওয়া যাবে না।’’ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে ‘গুন্ডামি’র (হুলিগানিজ়ম) অভিযোগ এনেছেন শুনে মদন পাল্টা বলেন, ‘‘যে নিজে পতিতা, সে-ই অন্যদের পতিতা বলে!’’
মদন জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে দলের কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় রাখেন না। বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দেখা হলে শুধু ‘কুশল বিনিময়’ হয়। আশ্চর্য নয় যে, প্রাক্তন মন্ত্রী তথা কামারহাটির বর্তমান বিধায়ক বলেছেন, ‘‘মন্ত্রিত্ব গিয়েছে। দলে গুরুত্বও কমেছে।’’ কথাপ্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতার বই লেখা নিয়েও কটাক্ষ করেছেন একদা মন্ত্রিসভায় তাঁর সহকর্মী। মদন বলেছেন, তিনি গত ২৩ মাসের ঘটনাবলি নিয়ে বই লিখলে সেই বই ‘বেস্টসেলার’ হবে। আমেরিকার লোকজনও সেই বই পড়বেন। মমতা প্রসঙ্গে মদনের বক্তব্য, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁর জন্য আমি বেঁচে আছি। আমার পরিবার বেঁচে আছে। আমি দেড় বছর জেলে থাকার পরেও তিনি আমার মন্ত্রিত্বে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। কিন্তু পার্থরটা (পার্থ চট্টোপাধ্যায়) দেড় দিনে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। মমতা পায়ের জুতো খুলে মারলেও আমি মেনে নেব। কিন্তু কেউ যদি বলে দল কারও প্রাইভেট, তা হলে সেটা ঠিক নয়। দল কারও প্রাইভেট হয় না। কেউ সেটা বললে তাঁকে বলব, ভারতের সংবিধান আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানটা ভাল করে পড়ে নিতে।’’
প্রসঙ্গত, বাম আমলে এসএসকেএম হাসপাতালে কার্যত মদনই ছিলেন শেষকথা। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও দীর্ঘ দিন মদনের সেই প্রতিপত্তি বজায় ছিল। সারদাকাণ্ডে গ্রেফতার হয়ে তিনি যখন অসুস্থ হয়ে এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি, তখনও তিনি এসএসকেএম হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু তার পরে তাঁকে দলের তরফেই ওই হাসপাতালের ‘দায়িত্ব’ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওই হাসপাতালের রোগী পরিচালন সমিতিতে আনা হয়েছিল মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে। পরে তাঁকেও সরিয়ে দিয়ে ওই দায়িত্বে আনা হয়েছে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে। কিন্তু মদনের একটা ‘অলিখিত কর্তৃত্ব’ এখনও ওই হাসপাতালে রয়েছে বলে অনেকে বলেন। শুক্রবার রাতে সেই ‘কর্তৃত্ব’ জোর ধাক্কা খেয়েছিল। তা আরও জোরালো হয় শনিবার হাসপাতালের ডিরেক্টরের বক্তব্য। তার পরেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন মদন। তবে তৃণমূলের আশা, শনিবারেই তাঁর সঙ্গে কথা বলে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে পারবেন কুণাল। কারণ, মদনের বক্তব্যের পর কুণাল বলেছেন, ‘‘শীর্ষস্থানীয়দের কেউ কেউ কিছু ভুলভাল বুঝিয়ে বিষয়টা জটিল করে ফেলেছেন। আমি মদন’দার সঙ্গে কথা বলব।’’