ভিটেহীন: সেকরাপাড়া লেনে পিয়ালী সেনদের বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ। হোটেলের ঘরে মা ও বৌদির সঙ্গে পিয়ালী (ডান দিকে ওপরে)। শাশুড়ি ও নাতনির সঙ্গে জয়া সেন। দুর্গা পিতুরি লেনের ভাড়াবাড়ি বিপজ্জনক ঘোষণা হওয়ায় এখনও সেখানে ফেরা হয়নি তাঁদের। নিজস্ব চিত্র
দাদু-ঠাকুরমাকে বলতে পারিনি, যেখান থেকে তাঁদের বার করে এনেছি, যা ছিল তাঁদের সবটুকু, সেখানে আর কোনও দিনই ফিরতে পারব না।
বাইরে রাস্তার হট্টগোল। মেঘ সরিয়ে রোদ্দুরের দেখা মিলেছে সবে। সেই মরা রোদ্দুরে প্রিন্সেপ স্ট্রিটের হোটেলের ঘরে বসে কথাগুলো বলছিলেন পিয়ালী সেন। হাতে মোবাইল ধরা। মোবাইলের স্ক্রিনে তখনও দেখা যাচ্ছে ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাওয়া পিয়ালীদের বাড়ির ফটো। বাড়ির স্মৃতি বলতে এখন ওটুকুই।
আজ, শনিবার থেকে শুরু দেবীপক্ষ। রাতারাতি ঠাঁইনাড়া হয়ে ওঁদের অনেকের কাছে এখন সেই হিসেবও আবছা। ‘‘মেট্রো বলেছিল যেন বেড়াতে যাচ্ছেন, সে রকম কয়েকটা জিনিস নিয়ে চলে যান! ২৯ তারিখ থেকে ২ তারিখ হোটেলে থাকতে হবে শুধু। তিন দিন বাদে তো ফিরছেনই। কিন্তু ফেরা আর হল কোথায়?’’— বলছেন পিয়ালী। দুর্গা পিতুরি ও সেকরাপাড়া লেনের মেট্রোর সুড়ঙ্গ-বিপর্যয়ে পিয়ালীদের দেড়শো বছরের পুরনো বাড়ি পুরো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ফলে সেকরাপাড়ার যে বাড়িতে ফেরার কথা ছিল ২ তারিখে, তা হয়ে ওঠেনি। আগামিকাল, রবিবার এক মাস পূর্ণ হবে হোটেল-যাপনের!
পিয়ালীর দাদু বছর ছিয়াশির চৈতন্য সেন কয়েক দিন ধরেই বলছেন, ‘‘আর ভাল লাগছে না। বাড়ি ফিরব না আমরা?’’ ঠাকুরমা রেখা সেন বলছেন, ‘‘কতদিন ঠাকুরের কাপড় পাল্টাইনি। ঠাকুরের ঘর পরিষ্কার করিনি। পুজো তো এসে গেল।’’ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করে পিয়ালী বলেন, ‘‘দাদু, ঠাকুরমা এখনও জানেন না যে বাড়িটা আর নেই!’’ পাশে বসা চার পোষ্য। ওদেরও মন খারাপ, জানালেন পিয়ালী।
কলিংবেলের আওয়াজ। কেউ এল?
‘‘ওই যে হোটেল থেকে খাবার দিতে এসেছে। সেই কবে থেকেই তো হোটেলের খাবার খাচ্ছি।’’, স্বগতোক্তি করলেন পিয়ালীর মা মমতা সেন। পিয়ালীর বাবা মারা গিয়েছেন ২০১০ সালে। মমতার আক্ষেপ, ‘‘জানেন ওর বাবার ফটোটা পর্যন্ত আনতে পারিনি।’’
সুড়ঙ্গ-বিপর্যয়ে ধসে পড়েছে একের পর এক বাড়ি। আর সেই বাড়ির তলায় চাপা পড়ে রয়েছে সাজানো-নিকনো গেরস্থালির সমস্ত চিহ্ন।—বাসনপত্র, টেলিভিশন, ফ্রিজ, যাবতীয় নথি, খাট, আলমারি, জামাকাপড়, ফটো, সবটুকু! শহরের হোটেলগুলিতে মেট্রো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু হোটেল তো আর বাড়ি নয়!
হোটেলে মমতাদের পাশের ঘরেই রয়েছেন ইন্দ্রজিৎ সেন, জয়া সেনরা। দুর্গা পিতুরি লেনে যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, তার অবস্থা বিপজ্জনক বলে জয়াদেবীদের ঠাঁই হয়েছে হোটেলে। জয়াদেবী মুশকিলে পড়েছেন। এক দিকে বছর ঊননব্বইয়ের অসুস্থ শাশুড়ি কমলাদেবীর প্রশ্ন সামলাতে হচ্ছে তাঁকে। ‘‘ও বৌমা, পুজোয় বাড়ি ফিরব না?’’ আবার তিন বছরের নাতনি আরাজ্ঞীও জানতে চাইছে, ‘‘ও ঠাম্মি আমাদের বাড়ি ভেঙে গিয়েছে?’’
সুড়ঙ্গ-বিপর্যয় কতগুলো ইট-কাঠের কাঠামোই মাটিতে মেশায়নি, জীবনের স্বাভাবিক ছন্দকেই দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। যেখান থেকে বেরোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সকলে। কিন্তু তাঁরা জানেন না এই অনিশ্চয়তার শেষ কোথায়। মেট্রো সূত্রের খবর, হোটেলে যাঁদের রাখা হয়েছে, তাঁদের ফ্ল্যাট দেখানো হচ্ছে। অনেককে বাড়িতে ফেরানোও হয়েছে। যদিও যাঁদের ফেরানো হয়েছে, তাঁদের অনেকেই ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। কারণ, বাড়িতে জল নেই, বিদ্যুৎ সংযোগও নেই। ‘‘এ কোথায় এসে পড়লাম? পশুরও অধম মনে হচ্ছে নিজেদের’’—অভিযোগ করছেন তাঁরা।
হোটেলে জয়াদেবীদের সামনের ঘরটাই পেয়েছেন বনশ্রী দত্ত, অনিতা দত্তেরা। পাড়ায় পুজো থাকে বরাবর। অন্য বার অনেক আগে থেকেই সব তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া, পুজোর জিনিস কেনা, হইহুল্লোড়! বলছিলেন তাঁরা। বনশ্রীর পাশে বসা অনিতা বললেন, ‘‘আর পুজো! এমন পুজো জীবনে কখনও আসতে পারে, দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। হোটেলে দিনের পর দিন এ ভাবে থাকতে থাকতে কবে কোন দিন, কবে কোন বার সব গুলিয়ে ফেলছি।’’
তবে সেই অনিশ্চয়তার মধ্যেই পরস্পরকে চিনত না, এমন দু’টি পরিবারও এখন ভাগ করে নিচ্ছে নিজেদের দুঃখের কথা। ‘‘বিপদের দিনের বন্ধুই তো আসল বন্ধু! তাই...’’, বললেন চিন্ময় দত্ত। বাড়ি ভাঙা হবে শুনে সকালে নিজেদের পাড়ায় গিয়েছিলেন তিনি। হোটেলে ফিরেছেন কিছু ক্ষণ আগে। চিন্ময় বললেন, ‘‘আর কিছু ওই ধ্বংসস্তূপ থেকে বার করতে পারব বলে মনে হয় না।’’
মাটি সরে গিয়েছে, নড়ে গিয়েছে স্থিতি। শুধু বাড়ির মেঝের নয়, জীবনেরও। মাটিচাপা পড়ে রয়েছে পরের পর সাজানো সংসার, যাবতীয় গেরস্থালির চিহ্ন।
দুর্গাপুজো সেখানে নতুন কোনও বার্তা বয়ে আনে না। সব ছাপিয়ে
‘বাড়ি ফিরতে পারব তো?’—হোটেলের বারো ঘর এক উঠোন জুড়ে ভাসে শুধু সেই প্রশ্ন।