ঐতিহ্য: চল রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন...। বিধান সরণি। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
হেমন্তের সন্ধ্যায় ঢং ঢং শব্দে রাস্তায় বেরিয়েও একটানা চলার উপায় নেই তার। হামেশাই অন্যের জন্য নিজের পথে দাঁড়াতে হয়। জন্মলগ্ন থেকে বাধা পেয়েও নীরবে সে পেরিয়েছে ১৪৬ বছর। বারবার নির্বাসন থেকে ফিরেও। এই শহরের ট্রাম আর তাকে ঘিরে নানাবিধ টানাপড়েন যেন সমার্থক।
১৮৭৩ সাল। শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাটের মধ্যে প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলল। কিন্তু যাত্রী না মেলায় মাস কয়েকের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় সেই ট্রাম। ১৮৮০ সালে ফিরে আসে ঘোড়ায় টানা ট্রাম।। অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা হয়েছিল ঘোড়াদের। ফের ধাক্কা। এ বার কলকাতার গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় মানিয়ে নিতে না পেরে অসুস্থ হয়ে মারা যেতে থাকে একের পর এক ঘোড়া। আবার বন্ধ ট্রাম। ফিরে এল বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে টানা ট্রামের রূপে। সেই ট্রামের ধাক্কায় একাধিক পথচারীর মৃত্যু হল। ফলে ট্রাম ঘিরে তৈরি হয়েছিল আতঙ্ক। কালো ধোঁয়া ওঠা ট্রাম দেখে তখন মুখ ঘোরাতেন শহরের সাহেব এবং বাবুরা।
১৯০২ সালে শহরের রাস্তায় ট্রাম ছুটতে শুরু করে বিদ্যুতে। পরের কয়েক দশকে সে শুধুই বাড়িয়েছে তার যাত্রাপথ। এর মধ্যেই মুম্বই, নাসিক, কোচি, চেন্নাই, দিল্লি ও কানপুরে ট্রাম চলতে শুরু করেছিল। মন্থর গতির অভিযোগ তুলে ১৯৬৪ সালে মুম্বই থেকে উঠে যায় ট্রাম।
কলকাতায় বাধা এল সাতের দশকের শেষে। মেট্রোর সুড়ঙ্গ তৈরি শুরু হলে জমি হারাতে থাকে ট্রাম। ১৯৯২ সালে তৎকালীন পরিবহণমন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তীর আমলে আয় বাড়াতে ট্রাম সংস্থা বাস চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সময় থেকেই ক্রমবর্ধমান গাড়ির জট এড়াতে বিভিন্ন রাস্তায় উড়ালপুল তৈরি শুরু হয়। টান পড়ে ট্রাম-পথে। শুধু তাই নয়, রাস্তার ধার থেকে ট্রাম লাইন সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মাঝপথে। ফলে ট্রামে যাত্রীদের অনায়াস ওঠানামা দুরূহ হয়ে যায়। যাত্রী হারানোর সেই শুরু।
ভিক্টোরিয়াকে পাশে রেখে ময়দানের কুয়াশা আর রোদ মাখা ট্রাম আজও ছোটে খিদিরপুরের দিকে। তবে মেট্রো আর উড়ালপুলের হিড়িকে দক্ষিণের ট্রাম উত্তরের তুলনায় বেশি জবুথবু। বাগবাজার থেকে গ্যালিফ স্ট্রিটের দিকে ট্রামের পথে রবিবারের গাছ-পাখির বাজার, লোকের ভিড়, রকমারি খাবারের দোকান সবই অতীত। শহরের সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হলের মতো এ শহর থেকে উধাও হয়েছে অনেক ট্রাম। এখন মাত্র সাতটি রুটে মোট ট্রাম চলে ৩৫টির মতো।
দূষণের কব্জায় নাজেহাল বিশ্বের কিছু দেশ ট্রামের গুরুত্ব বুঝে নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু করছে। লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, মস্কোয় পাতাল রেলের পাশাপাশি দিব্যি চলছে ট্রাম। পরিবেশবান্ধব এই গণ পরিবহণ ব্যবস্থার সমর্থনে বহু পরিবেশকর্মীও। গত কয়েক দশক ধরে শহরের ট্রাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ডিন দেবাশিস ভট্টাচার্যের মতে, “এখানে পরিবহণ সংক্রান্ত যে কোনও সমস্যার সমাধান খুঁজতে বসলেই ট্রামকে বাদ দেওয়া হয়। কোনও কারণে এক বার ট্রাম বন্ধ হলে, পরে আর তাকে ফিরিয়ে আনার কথাও ভাবা হয় না।’’
অথচ এ শহরের অন্ধকার দিনেও পাশে ছিল ট্রাম। ১৯৪৬ সালের ১৬ অগস্ট, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেয় মুসলিম লিগ। সেই সময়ে দাঙ্গা আক্রান্ত শহরবাসীর কাছে সম্প্রীতির বার্তা দিতে ধর্মঘটে শরিক হয়েছিলেন ট্রাম শ্রমিকেরা। ১৯৫৩ সালে ট্রামের ভাড়া বাড়লে শহরের রাস্তায় ট্রাম পুড়িয়ে বিক্ষোভ দেখায় ক্ষুব্ধ জনতা। সে সবই মনে করাচ্ছিলেন ট্রাম শ্রমিক আন্দোলনের গবেষক সিদ্ধার্থ গুহরায়।
বছর ছয়েক আগে গতি বাড়াতে পথে নেমেছে এক কামরার ট্রাম। তাতে বাড়ছে যাত্রী। নিউ টাউন এবং শহরের কিছু পথে নতুন করে ট্রাম চালুর দাবি নিয়ে সমীক্ষাও হয়েছে। ট্রামের দাবিতে চড়ছে আন্দোলনের স্বরও। তাদের দাবি একটাই, পরিবেশবন্ধু ট্রামের সঙ্গে অটুট থাক এ শহরের আত্মীয়তা।