কলকাতাকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসাবে গড়ে তুলতে যে পৌর উন্নয়নের কাজ হাতে নেওয়া হয়, তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল শহরের সবুজায়ন। কলকাতা কর্পোরেশনের তরফে রাস্তার ধারে গাছ বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয় ১৮৬৯ সালে। কিন্তু এই খাতে অর্থ খরচের আইনি অনুমোদন না থাকায় সে কাজ অচিরেই বন্ধ হয়। পরে আইনি জটিলতা কাটিয়ে ফের শুরু হয় বৃক্ষরোপণ। ১৯০৫ সালে রাস্তার এবং বিভিন্ন পার্ক ও স্কোয়ারের গাছগুলির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পায় পৌর সংস্থার ‘স্কোয়ার কমিটি’। ১৯১৪ সালে রয়াল বোটানিক্যাল সোসাইটি-র আধিকারিক জি টি লেন-কে দিয়ে কলকাতা ও শহরতলির পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষ সমীক্ষা করিয়ে তাঁকেই নিযুক্ত করা হয় বছরে দু’বার— শহরের গাছপালার দেখাশোনা ও নতুন গাছ লাগানোর কাজে। ১৯১৩-১৪ ও ১৯১৪-১৫ সময়কালে এ কাজে কর্পোরেশনের ব্যয় হয়েছিল যথাক্রমে ত্রিশ ও চুয়াল্লিশ হাজার টাকা। কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট গঠিত হওয়ার পর দশ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছিল শহরের সবুজায়ন এবং পার্ক ও স্কোয়ারগুলির উন্নতির জন্য।
১৯৪৬ সালে শহর ও শহরতলির প্রথম পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষতালিকা প্রস্তুত করে এ পি বেন্টল তাঁর দ্য ট্রিজ় অব ক্যালকাটা অ্যান্ড ইটস নেবারহুড বইয়ে জানিয়েছেন, শহরের রাস্তাগুলি সাজাতে বেছে নেওয়া হয়েছিল এমন সব প্রজাতির গাছ যেগুলি খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে কিন্তু ঝড়ের দাপটে সহজে ভাঙে না— আবার সারা বছর ছায়া দেয় অথচ এলোপাথাড়ি ডালপালা ছড়িয়ে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগের ব্যবস্থায় কোনও বিঘ্ন ঘটায় না। পুত্রঞ্জীব, দেবদারু, বকুল, ছাতিম, স্প্যানিশ মেহগনি ছিল নগর পরিকল্পনাকারীদের পছন্দের গাছ। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ক্রান্তীয় জলবায়ুর গাছ এনে লাগানো হয়েছে এ শহরে। উনিশ শতকেই এসেছে বিলিতি শিরীষ বা রেন ট্রি। তার পর বিশ শতকের দিকে তৈরি সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ সাজানো হয়েছিল জারুল গাছ দিয়ে। এই সময়েই শহরে প্রথম লাগানো হয় পোর্শিয়া বা পরশপিপুল। আজকের শহরে খুব পরিচিত কিছু গাছ, যেমন কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আর আর রক্তকম্বল বেশ বিরল ছিল সে সময়। আবার সেই লেখায় উল্লিখিত ক্যামাক স্টিটের নিশিন্দা গাছের ঝাড় একেবারে অচেনা অপরিচিত লাগবে আজকের নাগরিক পথচারীর।
সাহেবদের পাশাপাশি ছিল বাঙালির অবদানও। তাঁদের কল্যাণেও নতুন প্রজাতির নানা গাছ এসেছে শহরে। বেলগাছিয়ার পাশেই আজকের দত্তবাগানে ছিল হাটখোলার হরসুন্দর দত্তের বাগান। আনুমানিক ১৮২৮ সালে তিনি অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তাঁর সম্পত্তির মালিক হন দৌহিত্র আনন্দ মিত্র। নানা জাতির ফল-ফুলে সাজিয়ে আনন্দবাবু সেই বাগানকে এক দ্রষ্টব্য স্থান করে তোলেন। কোনও আমেরিকান জাহাজের কাপ্তান এই বাগান দেখে খুশি হয়ে পরে তাঁর দেশ থেকে ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরা-র (বাংলায় উদয়পদ্ম) চারা এনে দেন। আজ দত্তবাগানের সঙ্গে সেই গাছ হারিয়ে গেলেও যতীন্দ্রমোহন ওরফে যম দত্তের লেখায় রয়ে গিয়েছে সে দিনের স্মৃতি। শহরের পরিবেশ রক্ষায় গাছেদের ভূমিকা মনে করার পাশাপাশি শহরের বদলে যাওয়া বৃক্ষ-মানচিত্রের দিকেও ফিরে দেখা দরকার— বিশেষত বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আবহে। ছবিতে আলিপুর জ়ুলজিক্যাল সোসাইটিতে আফ্রিকান বাওবাব গাছ, ২০০৭ সালের ছবি।a
মাইলফলক
১৯২১-এ লন্ডনে আত্মপ্রকাশ করে ‘পি ই এন ইন্টারন্যাশনাল’ সংগঠনটি (চলতি কথায় ‘পেন’)— কবি নাট্যকার প্রাবন্ধিক ঔপন্যাসিক সম্পাদকদের সম্মিলিত মঞ্চ। এর বঙ্গীয় শাখার পথ চলা শুরু ১৯৩৪-এর ২ ডিসেম্বর। প্রথম সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ছবি), প্রথম সম্পাদক মণীন্দ্রলাল বসু। শুরু থেকেই এই সংগঠনের উদ্দেশ্য লেখকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই, আজও যা অব্যাহত। নানা সময়ে পেন-এর বঙ্গীয় শাখার সভাপতি ছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নবনীতা দেব সেন-সহ বাংলার বহু প্রথিতযশা সাহিত্যিক। এই সংগঠনের নব্বই বছর উপলক্ষে আগামী ১৩ জুন মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টায় বাংলা আকাদেমি সভাঘরে এক সাহিত্যসন্ধ্যার আয়োজন হয়েছে, প্রধান অতিথি রামকুমার মুখোপাধ্যায় ছাড়াও থাকবেন সুমিতা চক্রবর্তী, সুবোধ সরকার এবং আরও অনেকে। রয়েছে বই প্রকাশ, কবিতা পাঠের আসরও।
না-দেখা ছবি
২০০৮-এ শুরু হয় ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ় অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস, কলকাতার ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের পথ ধরে চলচ্চিত্র ও অন্য শিল্পমাধ্যমের চর্চাকে বহতা রাখাই এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য— চলচ্চিত্র প্রদর্শন, চলচ্চিত্র উৎসব, বক্তৃতা, আলোচনার মাধ্যমে। প্রযুক্তির কল্যাণে আজ ঘরে বসে হয়তো তথাকথিত বিরল ছবিও দেখা যায়, কিন্তু সকলে মিলে সে ছবি দেখলে জানা যায় মনের কথাও। সেই লক্ষ্যেই আগামী ১৬ ও ১৭ জুন নন্দন-৩’এ টিউনিজ়িয়ান ছবির উৎসব আয়োজন করেছে তারা। বিকেল ৪টা ও সন্ধ্যা ৬টায় দেখানো হবে মোট চারটি ছবি: লুক অ্যাট মি, আ সান, লামেস আর বিফোর ইট’স টু লেট। প্রযুক্তিমাধ্যমে উদ্বোধন করবেন ভারতে টিউনিজ়িয়ার মাননীয় রাষ্ট্রদূত, থাকবেন গৌতম ঘোষ ও অশোক বিশ্বনাথন।
হাজার কণ্ঠে
ইউরোপ ভ্রমণকালে সেখানকার সঙ্গীতের ভিতর দিয়ে জাতিসত্তার সম্মিলিত রূপ দোলা দিয়েছিল রবীন্দ্রমনে, কোনও সঙ্গীতানুষ্ঠানে সহস্র কণ্ঠ ও যন্ত্রের সঙ্গীত গেঁথে গিয়েছিল তাঁর মনে, ঘনিষ্ঠ মহলে বলতেন সে স্মৃতি— বলছিলেন অরুন্ধতী দেব। তাঁর পরিচালনায় ‘হাজার কণ্ঠে সম্মেলক রবীন্দ্রসঙ্গীত’ কবির সেই অনুক্ত বাসনারই শিল্পরূপ। ‘সঙ্গীত ভারতী মুক্তধারা’ আয়োজিত এ অনুষ্ঠান প্রথম হয় ২০০৭-এ, গীতবিতান-এর পঁচাত্তর পূর্তিতে, পরে কবির সার্ধশতবর্ষেও। এ বার অনুষ্ঠিত হবে নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে, ১৮ জুন বিকেল সাড়ে ৫টায়। গান-কবিতা-নৃত্যে এ বার বিষয় ‘নটরাজ ঋতুরঙ্গশালা’। ভারতের বারোটি রাজ্যের শহর থেকে আসছেন শিল্পীরা। “কবির বিশ্ববোধে উপনীত হওয়াই লক্ষ্য,” জানালেন অরুন্ধতীদেবী।
বাউল-কথা
বাউলের সাধন নিয়ে বইপত্র কম নেই, কিন্তু সে সবই ‘বাইরে’ থেকে দেখা। বিশ্লেষণ আর উপলব্ধির মধ্যে যে তফাত, তা পূরণ করতে পারে খোদ বাউল সাধকের লেখা বই। তেমনই একটি বই বাউল প্রেমিক, সনাতন দাস বাউলের সম্পূর্ণ সাধনজীবনের ফসল। যেন এক বাউল ও এক প্রেমিকের কথোপকথন: প্রেমিক প্রশ্ন করেন, বাউল তাঁর জ্ঞানভান্ডার থেকে পদ সহায়ে সমাধান জোগান সে প্রশ্নের, ক্রমে প্রবেশ করেন গভীর সাধনতত্ত্বে। বাউল মার্গ শ্রুতিনির্ভর, সেই ধারার অনুসরণে গড়ে ওঠা এ বই বাউল সমাজের আকরগ্রন্থ, সম্পদও। নবতম সংস্করণে প্রকাশিত হচ্ছে আজ সন্ধ্যা ৬টায় আইসিসিআর-এর সত্যজিৎ রায় প্রেক্ষাগৃহে, পার্বতী বাউল ও তাঁর সুজনদের উদ্যোগে। যুক্ত হয়েছে অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি, সাক্ষাৎকার, সঙ্গীত, ছবি, অডিয়ো ট্র্যাকও।
থিয়েটার নিয়ে
‘আগে জীবিকা, পরে অভিনয়’। বাংলার থিয়েটারে এ তর্ক আজকের নয়। সমাজ ও সময়ের বাঁক বদলের সঙ্গে সঙ্গে আজকের নাট্যকর্মীরা কে কী ভাবে থিয়েটার-অভিনয়কে দেখেন, তার খোঁজ রাখার দরকার আছে বইকি। তর্কের মোড়কে সেই আলোচনাই তুলে আনছে নাট্যগোষ্ঠী ‘যোজক’, আগামী কাল ১১ জুন বিকেল ৪টেয়, বাগুইআটি জোড়ামন্দিরের শিবাঙ্গন-এ। প্রথম পর্বে আলোচনা, বলবেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ও সোহিনী সেনগুপ্ত। সন্ধে সাড়ে ৬টা থেকে হবে কর্মশালা, ‘গানে জ্ঞানে শিল্পীর মনুষ্যত্ব’ প্রসঙ্গে প্রশিক্ষক শুভেন্দু মাইতি, ‘থিয়েটার ও শরীর’ বিষয়ে অঞ্জন দেব। দুলাল লাহিড়ী, রজত মল্লিক-সহ সমগ্র যোজক পরিবারের এই আয়োজনে যোগ দিতে পারেন সকলেই।
গ্রামবাংলার রান্না
শীতের সকালে খেজুরগুড় দিয়ে গরম কলাই রুটি। দুপুরে নদীর টাটকা ট্যাংরা মাছের পাতুরি। বাংলার গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে নানা ঐতিহ্যবাহী রান্না, তেমন প্রচার নেই। স্থানীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই পদ ও তার রন্ধনপদ্ধতির সংরক্ষণ ও প্রচার প্রয়োজন, সেই ভাবনা থেকেই উদ্যোগ করেছে ‘বাংলানাটক ডট কম’ গত দুই দশক ধরে ভারতময় স্থানীয় পারম্পরিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য চর্চার প্রতিষ্ঠান। বাংলার গ্রামীণ ‘রেসিপি’কে তুলে ধরতে তারা শুরু করেছে একটি ইউটিউব চ্যানেল, ‘রুরাল রেসিপিজ়’। শুক্তো, দই পটল-সহ বাংলার নানা প্রান্তের খাবার ও সম্পূর্ণ রন্ধনপ্রণালী সেখানে; গীতা শীলের রাঁধা মাছ পাতুরি, গোরভাঙার মাসুদা বিবির কলাই রুটি, রিনা মুখোপাধ্যায়ের হাতের মুরগির ঝাল চচ্চড়ি, বর্ণা দত্তের তেল-ছাড়া চিকেন কাদম্বরী। থাকছে রন্ধনশিল্পীদের জীবনের গল্পও। ছবিতে সহজ পাঠ-এ নন্দলাল বসুর অলঙ্করণ।
শিল্পীর মন
শিল্পীসত্তার অতলে কী ভাবে কাজ করে কল্পনা? কী ভাবে বাঁক নেয় সে, এগিয়ে চলে বিশেষ লক্ষ্যের অভিমুখে! পরম্পরা-আশ্রিত শিল্প ও আধুনিক শিল্পীর নিজস্বতায় কতখানি ফারাক? লোকশিল্পই কি আধুনিক চারুকলার বনিয়াদ? গ্রামীণ পালাপার্বণের আলপনার পাশে শান্তিনিকেতনের আলপনার দৃশ্যগত প্রভেদ কি কেবল নির্মাণ-আঙ্গিকের, না কি দূরত্ব এদের উৎসেই নিহিত! ২০১৯ সালে দুর্গাপূজায় ঠাকুরপুকুরের এক পুজোর মণ্ডপসজ্জায় আলপনাশিল্প নিয়ে কাজ করেছিলেন সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও পার্থ দাশগুপ্ত, এই সব প্রশ্নই তখন উঠে এসেছিল দুই শিল্পীর মনে। সে কাজ ডকুমেন্টেশন করে রাখা হয়, যাতে ভবিষ্যৎ প্রয়োজনে ফেরা যায় বৃহত্তর প্রশ্নগুলির উত্তর সন্ধানে। এসেছে সুযোগ, শিল্পীদের সে কথা শুনবে সাংস্কৃতিক মঞ্চ ‘শতদল’। ‘শিল্পীর মন: কল্পনার আলপনা’ প্রসঙ্গে তাঁদের সঙ্গে আলাপে সুশোভন অধিকারী, আজ ১০ জুন বিকেল ৫টায়, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, গোলপার্কের শিবানন্দ হলে। ‘নির্মলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক আলোচনা’র দ্বিতীয় বর্ষ, এসরাজ বাদনে দেবায়ন মজুমদার।
অন্য রকম
বই নিয়েই তো লাইব্রেরি। বড়জোর, প্রযুক্তিধন্য এ বিশ্বে ডিজিটাল কনটেন্ট-এর লাইব্রেরি হতে পারে, বই-পেনড্রাইভের আদানপ্রদান হচ্ছে সদস্যদের মধ্যে, এই অবধি কল্পনা করা যায়। কিন্তু এ সব ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে লাইব্রেরি, সে কেমন? গ্যোয়টে ইনস্টিটিউট-ম্যাক্সমুলার ভবন তেমনই এক লাইব্রেরি খুলতে চলেছে আগামী ১৩ জুন থেকে: ‘লাইব্রেরি অব থিংস’। কী থাকবে সেখানে? রোজকার জীবনের নানা জিনিস: স্পিকার, টুল বক্স, খেলার সরঞ্জাম, বাইনোকুলার, টেলিস্কোপ, ডিভিডি প্লেয়ার, এমনকি সেলাই মেশিন, রুকস্যাক, ছোট তাঁবুও! পরিবেশবন্ধুতা, সেই সঙ্গে পকেটের সাশ্রয়ের কথা মাথায় রেখে এ-হেন উদ্ভাবন। আপাতত এই গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে পারবেন এ প্রতিষ্ঠানের বই-লাইব্রেরির সদস্যরাই শুধু, তবে— ‘আইডিয়া মন্দ নয়’।