কখনও আবার জিজ্ঞাসাবাদের নামে বিদ্যুতের শক দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ফাইল ছবি
কখনও কোনও পুলিশকর্মীর নাম করে তুলে এনে পুলিশেরই গাড়িতে ঘোরানো হয়েছে দিনভর। অভিযোগ, চলেছে বেধড়ক মারধরও। কখনও ‘বড়বাবু কথা বলতে চান’ বলে ডেকে এনে থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেই সময়ে যেতে দেওয়া হয়নি শৌচাগারেও! কখনও আবার জিজ্ঞাসাবাদের নামে বিদ্যুতের শক দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সামনে এসেছে সাধারণ পোশাকে তুলে আনতে গিয়ে খুনের অভিযোগও!
আনিস-কাণ্ড থেকে সাম্প্রতিক গল্ফ গ্রিন থানার ঘটনা! আইনের শাসনের নামে পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধেই আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বার বার। কর্তব্যরত অবস্থায় তো বটেই, অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছে ডিউটিতে না-থাকা সিভিক ভলান্টিয়ার বা হোমগার্ডের বিরুদ্ধেও। কিছু ক্ষেত্রে সাসপেন্ড বা ক্লোজ় করে ব্যবস্থা নেওয়ার তত্ত্ব খাড়া করা হলেও কয়েক দিন আলোচনার পরে পরিস্থিতি আগের মতোই হয়ে যায় বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। আইনজীবী থেকে প্রাক্তন পুলিশকর্তাদের অনেকের আবার প্রশ্ন, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবেই কি নিচুতলার পুলিশকর্মীরা বার বার এমন ঘটনায় জড়াচ্ছেন?
দীপঙ্কর সাহা ওরফে ছোটকা নামে ৩৪ বছরের এক যুবককে পিটিয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে গল্ফ গ্রিন থানার পুলিশের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় লালবাজার একটি বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট গঠন করেছে বলে খবর। বুধবারই অভিযুক্ত এক সার্জেন্ট এবং এক কনস্টেবলকে সাসপেন্ড করার পাশাপাশি বরখাস্ত করা হয়েছে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে। মৃতের পরিবারের দাবি, থানার এক সার্জেন্ট কথা বলতে চান বলে জানিয়ে সাদা পোশাকে আসা দুই ব্যক্তি পুলিশ পরিচয় দিয়ে দীপঙ্করকে নিয়ে যান। কিন্তু তাঁকে থানায় ডাকার বৈধ কাগজপত্র তাঁরা দেখাতে পারেননি।
আইনজীবীরা যদিও জানাচ্ছেন, গুরুতর অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলে তাঁকে সমন পাঠাতে হয়। গ্রেফতারি বা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কাউকে থানায় নিয়ে আসতে গেলে পুলিশকর্মীর বুকে নাম ও পদ-সহ ব্যাজ থাকা বাধ্যতামূলক। যে সব অপরাধে সাত বছরের কম সাজা হওয়ার কথা, সে ক্ষেত্রে গ্রেফতার বা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিস পাঠিয়ে ডাকতে হয়। গ্রেফতার করার আগে অবশ্যই জানাতে হবে, অভিযোগটা কী। গ্রেফতারির পরে দিতে হবে ‘অ্যারেস্ট মেমো’। সেই সঙ্গে মহিলা রয়েছেন, এমন বাড়িতে বড় অপরাধীকে ধরতেও রাতে পুলিশ ঢুকতে পারে না। ঢুকলে মহিলা পুলিশকর্মী থাকা বাধ্যতামূলক।
আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, সূর্যাস্তের পরে এবং সূর্যোদয়ের আগে, অর্থাৎ অন্ধকার হয়ে গেলে সঙ্গে মহিলা কনস্টেবল থাকলেও পুলিশ কোনও মহিলাকে গ্রেফতার করতে পারে না। যদি কোনও মহিলা গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হন এবং পুলিশ রাতেই তাঁকে গ্রেফতার করতে চায়, তা হলে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিয়ে, মহিলাকে তা দেখিয়ে তবে গ্রেফতার করতে হবে। কোনও মহিলাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও থানায় ডেকে পাঠাতে পারে না পুলিশ। ভারতীয় মহিলাদের এই অধিকার দিয়েছে ফৌজদারি আইনের ১৬০ নম্বর ধারা। মহিলার বাড়িতে এসে, মহিলা কনস্টেবল এবং আত্মীয়দের উপস্থিতিতে পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে।
কিন্তু অতীতের একাধিক ঘটনায় এই নিয়মকানুন খাতায়-কলমেই থেকে গিয়েছে বলে অভিযোগ।
২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সিঁথি থানায় পুলিশি হেফাজতে স্নেহময় দে নামে এক প্রৌঢ়ের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। মৃতের পরিবার দাবি করে, নোটিস ছাড়াই নিয়ে গিয়ে অত্যাচার চালানো হয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই থানাতেই একই ভাবে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু হয় রাজকুমার সাউ নামে আর এক ব্যক্তির। এ ক্ষেত্রে পরিবারের অভিযোগ, জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ায় মৃত্যু হয় ওই ব্যক্তির। ২০১৫ সালে বড়তলা থানায় ভূষণ দেশমুখ নামে এক বন্দির রহস্যজনক মৃত্যু হয়। প্রথমে বলা হয়েছিল, পেটের গোলমালে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয়েছে। ময়না-তদন্তের রিপোর্টে অবশ্য মৃত্যুর কারণ মেলে ‘মারধর’! গল্ফ গ্রিনে মৃতের দাদা সানি সাহা বললেন, ‘‘ঘটনা ঘটে, কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই কড়া শাস্তির কথা শোনা যায় না। কড়া সাজা না হলে পুলিশকর্মীদের নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে মনে করার রোগ সারবে না।’’