বইমেলায় লাঠি দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে র্যাম্প-সহ শৌচাগারের দরজা। জিনিসপত্র রেখে সঙ্কীর্ণ হয়েছে প্রবেশপথ। —নিজস্ব চিত্র।
গত ১৮ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে ৪৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, এমন বইপ্রেমীদের বড় অংশের ক্ষোভ রয়েছে এই বইমেলা ঘিরে। তাঁদের মতে, গত কয়েক বছরের চেষ্টাতেও কলকাতা বইমেলা প্রতিবন্ধী-বান্ধব হল না।
অভিযোগ উঠছে, চলতি বছরের বইমেলায় যে সমস্ত বড় স্টলে র্যাম্প করা হয়েছে, বহু ক্ষেত্রেই সেখানে হুইলচেয়ার ঢুকছে না। র্যাম্প-সহ শৌচাগার থাকলেও সেখানে জিনিসপত্র রেখে লাঠি দিয়ে দরজা বন্ধ করা আছে। প্রতিবন্ধীদের সাহায্যের জন্য স্বেচ্ছাসেবক বা ব্যাটারিচালিত গাড়িও নেই প্রাঙ্গণে। বইমেলা কর্তৃপক্ষ নিজেরাই জানিয়েছেন, সব মিলিয়ে প্রায় এক হাজার স্টলের প্রাঙ্গণে রয়েছে মাত্র চারটি হুইলচেয়ার।
‘দি অর্গানাইজ়েশন অব রেয়ার ডিজ়িজ়েস অব ইন্ডিয়া’, ‘হুইলচেয়ার ইউজ়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এর মতো একাধিক সংগঠনের অভিযোগ, সমস্যার সমাধান চেয়ে তাদের এক বার কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজক সংস্থা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের দফতরে, এক বার নগরোন্নয়ন দফতরে ছুটতে বলা হচ্ছে। দায়িত্ব ঠেলাঠেলির এই ফাঁকে অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা বইপ্রেমীদের বইমেলা ঘুরে দেখার ইচ্ছে।
‘হুইলচেয়ার ইউজ়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’ জানিয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে বইমেলা কর্তৃপক্ষকে প্রতিবন্ধীদের অনুকূল পরিকাঠামো তৈরির অনুরোধ করা হলেও ২০২২ সাল পর্যন্ত কিছুই হয়নি। একাধিক ইমেল করার পরে ওই বছরের নভেম্বরে গিল্ডের সঙ্গে আলোচনায় বসেন সংগঠনের সদস্যেরা। সংগঠনের তরফে প্রিয়াঙ্কা দে বলেন, ‘‘কর্তৃপক্ষের তরফে কোনও উৎসাহ না দেখে কেন্দ্রের ‘ডিপার্টমেন্ট অব এমপাওয়ারমেন্ট অব পার্সনস উইথ ডিজ়এবিলিটিজ়’-এ চিঠি লিখে সব জানাই। ওই বিভাগ থেকে জেলাশাসকের কাছে চিঠি যায়। এর পরেই ২০২৩-এর বইমেলার আগে প্রতিবন্ধী-বান্ধব পরিকাঠামো তৈরির নির্দেশ যায় গিল্ড কর্তৃপক্ষের কাছে।’’
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক প্রিয়াঙ্কা দে সেরিব্রাল পলসির কারণে সম্পূর্ণ হুইলচেয়ার বন্দি। গত বছর নিজের পাওয়ার হুইলচেয়ার নিয়ে তিনি হাজির হন বইমেলায়। কিন্তু র্যাম্প দিয়ে সেটি উঠতেই পারেনি। প্রতিবন্ধী-বান্ধব পরিকাঠামো যথাযথ হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য মেলা শুরুর আগে তাঁদের সংগঠনকে জানালে খামতিগুলো সংশোধন করা যাবে, ফের বইমেলা কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি এই আবেদন জানান। তার সদুত্তর মেলেনি বলেই দাবি প্রিয়াঙ্কার।
বইমেলা কর্তৃপক্ষের ব্যবহারে বিরক্ত ‘দি অর্গানাইজ়েশন অব রেয়ার ডিজ়িজ়েস অব ইন্ডিয়া’র স্টেট কোঅর্ডিনেটর দীপাঞ্জনা দত্ত। তিনি বলছেন, ‘‘এত বড় মেলায় প্রতিবন্ধীদের জন্য যথোপযুক্ত পরিকাঠামো করতে এত সমস্যা হবে কেন? এঁদের কাছে তো বই-ই বন্ধু।’’ বইমেলায় প্রতি বছর মেয়ে দেবস্মিতাকে নিয়ে আসেন মৌমিতা ঘোষ। স্নায়ুঘটিত বিরল রোগ, স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফিতে (এসএমএ) আক্রান্ত দেবস্মিতা ছোট থেকে হুইলচেয়ারে বন্দি। তবুও বইপোকা দেবস্মিতাকে মা-বাবা নিয়ে আসেন মেলায়। কয়েকটি স্টলের সামনে হুইলচেয়ার রেখে তাঁরা দেবস্মিতাকে বাইরে থেকে বই দেখান। ‘কিয়োর এসএমএ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা মৌমিতা বলছেন, ‘‘ভাবতে কষ্ট হয়, আজও শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় পাশে নেই কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা কর্তৃপক্ষ। বেশির ভাগ স্টলেই র্যাম্প নেই। থাকলেও এতই দায়সারা ভাবে করা যে, হুইলচেয়ার ওঠানো যায় না।’’
তবে, বইমেলাকে প্রতিবন্ধী-বান্ধব করতে না চাওয়ার অভিযোগ মানতে নারাজ কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দাবি, অধিকাংশ স্টলেই র্যাম্প আছে। পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক সুধাংশুশেখর দে বলেন, ‘‘১৫০-২০০ বর্গফুট আয়তনের স্টলে র্যাম্প নেই। বড় সব স্টলে ও প্যাভিলিয়নে র্যাম্প আছে। তা সত্ত্বেও কোন স্টলে হুইলচেয়ার উঠছে না, তা জানালে দেখে নেব। তবে র্যাম্প-সহ শৌচাগার কেন বন্ধ থাকবে, সেটা দেখে নিচ্ছি।’’