কলকাতা শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ছোট-বড় নানা সংগ্রহালয়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা ভারতীয় সংগ্রহালয়ের মতো প্রাচীন ও বৃহৎ সংস্থার পাশাপাশি ডাকটিকিট, মুদ্রা, নৌকা বা ট্রামকে বিষয় করেও সংগ্রহশালা আছে শহরে। শহরের বহু সংগ্রাহকও তাঁদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ গড়ে তুলেছেন, যার মধ্যে কয়েকটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ প্রদর্শনী ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে মিউজিয়ামগুলি বিশেষ নিদর্শনের প্রদর্শনী, আলোচনাচক্র, উৎসব ইত্যাদির আয়োজন করে থাকে। সংগ্রহশালাগুলির মূল উদ্দেশ্য এই সব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অতীত-ইতিহাস সংরক্ষণ সম্পর্কে নাগরিকদের সচেতন করা।
বেহালার সাবর্ণ সংগ্রহশালা তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান। এর পরিচালন কর্তৃপক্ষ, সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদ প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে আয়োজন করে আন্তর্জাতিক ইতিহাস উৎসব, এ বছর আঠারোতে পড়ল। শহরের বিশিষ্ট সংগ্রাহকদের অমূল্য সংগ্রহ উৎসবে সেজে উঠবে দশটি ‘থিম’-এ বাঁধা প্রদর্শনীতে। মৃণাল সেন ও তপন সিংহের জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য: তাঁদের ব্যবহৃত জিনিসের পাশাপাশি থাকবে সিনেমার পোস্টার, বুকলেট, ছবি ইত্যাদি। রাজেন্দ্র প্রসাদ থেকে শুরু করে প্রফুল্ল সেন, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী প্রমুখের লেখা চিঠি থাকবে প্রদর্শনীর আর একটি ভাগে। ১৯৩৭ থেকে কলকাতার ট্রামের টিকিটের (প্রথম ছবি) যাত্রা ‘ট্রামের এ কাল-সে কাল’ বিভাগে।
দেশভাগ-পরবর্তী উত্তাল রাজনৈতিক সময়ের প্রেক্ষাপটে ‘প্রণয়ের গান গাহিতে বোলো না মোরে’ গানটি গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে রেকর্ড করেছিলেন সঙ্গীতশিল্পী সত্য চৌধুরী। প্রণব রায়ের লেখা গানে সুর দিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার গানটিতে হিংসা ও হানাহানির চিত্র নিয়ে আপত্তি তোলে। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক রাখতে গানটি নিষিদ্ধ করে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়। প্রদর্শনীতে প্রাসঙ্গিক সব তথ্য সাজিয়ে দেওয়া ছাড়াও, গানটি শোনানোরও ব্যবস্থা হয়েছে।
উৎসবে ‘থিম কান্ট্রি’ ইটালি, ভারত-ইটালি সম্পর্ক তুলে ধরা হবে নানা প্রদর্শে (রোমান অলঙ্কার ও মৃৎপাত্র, তৃতীয় ও চতুর্থ ছবিতে)। থাকছে রামায়ণ বিষয়ে তাইল্যান্ড কম্বোডিয়া সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া নেপাল ভুটান-সহ ২৮টি দেশের ডাকটিকিট-সম্ভার। দেখানো হবে অভিষেকের সময় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের পোশাকে ব্যবহৃত একটি ‘টাসেল’ বা ঝালর (উপরে, দ্বিতীয় ছবি)। সরস্বতী পুজোর সঙ্গে উৎসবের সময় মিলে যাওয়ায় বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে বাগ্দেবীর উপস্থাপনায় (মাঝের ছবি) সেজে উঠেছে একটি বিভাগ। থাকবে হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়ো সভ্যতার অস্ত্র ও নানা সামগ্রী। আগামী ১১ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা উৎসব চলবে সাবর্ণ রায়চৌধুরী বড় বাড়িতে। সম্মানিত হবেন সংস্কৃতিজগতের বিশিষ্টজন, থাকবে কুইজ, আলোচনা, হেরিটেজ ওয়াকও।
প্রফুল্ল-প্রদর্শ
প্রবাসী পত্রিকায় গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কার্টুন এঁকেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে নিয়ে। বেঙ্গল কেমিক্যাল-এর কালি জলে ধুচ্ছেন, এতই ভাল তা যে জলে ধুলেও রং যাচ্ছে না (ছবি)। শিক্ষক, রসায়নবিদ, শিল্প-উদ্যোক্তা প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রয়াণের আশি পূর্ণ হবে এ বছর। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ সম্পর্ক মনে রেখে ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ঐক্যকেন্দ্র’ আয়োজন করেছে ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি প্রদর্শনী, রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের মেঘনাদ সাহা অডিটোরিয়ামে আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর দু’টোয়। রয়েছে আলোচনাও, থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার, বিজ্ঞানীকে নিয়ে বলবেন শুভময় দাস ও প্রবীর মুখোপাধ্যায়। প্রফুল্লচন্দ্রের লেখা বই, দুর্লভ নানা ছবি দেখা যাবে প্রদর্শনীতে; সায়েন্স কলেজের রসায়ন বিভাগে রক্ষিত তাঁর গবেষণাগারটি সে দিন দেখতে পাবেন দর্শকরা। সঙ্গের ছবিটি প্রদর্শনী থেকে।
ফরাসি সুগন্ধ
বসন্তের শহরে ফরাসি ছবির উৎসব। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ় ও নন্দন-এর একত্র উদ্যোগে, কলকাতায় কনসুলেট জেনারেল অব ফ্রান্স-এর সহযোগিতায় ‘ফ্রেঞ্চ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কলকাতা ২০২৪’ আগামী ১৬ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি, নন্দনে ও পার্ক ম্যানসনে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ়-এ। এই সময়ের ফরাসি কাহিনিচিত্র তো বটেই, দেখা যাবে ফরাসি ছোট ছবি, অ্যানিমেশন-ছবি; ফরাসি নবতরঙ্গের সাড়া-জাগানো ছবিগুলির পাশে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসাবে দেখানো হবে ভারতীয় তথা বাঙালি চিত্রপরিচালকদের ছবিও। ছবি তৈরির নানা দিক-আঙ্গিক নিয়ে আলোচনাও অঙ্গ উৎসবের, করবেন বিশিষ্ট অভিনেতা চিত্রনির্মাতা ও লেখকেরা। বিশদ তথ্য আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ়-এর ফেসবুক পেজে, উৎসবে স্বেচ্ছাসেবক চেয়ে বার্তাও আছে সেখানে।
উৎসব-নাট্য
‘সংসৃতি’ নাট্যদলের ত্রিশ বছর পূর্ণ হল, কর্ণধার দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় নানাবিধ নাট্যনির্মাণ এ যাবৎ অভিনীত হয়েছে কলকাতা-সহ সারা ভারতে। এক দিকে যেমন শিল্পনির্মাণের বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিচিত্র স্বাদের নাটক দর্শককে উপহার দিয়েছেন, অন্য দিকে তাঁদের প্রশ্নাতুর ও সংশয়াচ্ছন্ন করে তুলেছেন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শাসকশ্রেণি সম্পর্কে। দেবেশের নাট্যজীবনেরও পঁয়ত্রিশ বছর, ফলত অ্যাকাডেমি মঞ্চে আগামী ১৯-২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর পরিচালিত ন’টি নাটকের (সাতটি সংসৃতি-র প্রযোজনা, একটি চাকদহ নাট্যজন-এর, একটি পঞ্চম বৈদিক-এর) অভিনয়: কোথাকার চরিত্র কোথায় রেখেছ, খোক্কস, শের আফগান, একদিন মন্দিরে যাওয়ার পথে, ব্রেন, ফ্যাতাড়ু, হয়বদন, ব্যারিকেড, আমোদিত রোদ্দুর।
ইতিহাস ছুঁয়ে
১৯০০ সালে, শ’খানেক বই নিয়ে হাওড়ায় নিজের বাড়িতে নৃসিংহ বসু শুরু করেন রামকৃষ্ণপুর লাইব্রেরি অ্যান্ড ফ্রেন্ডস সেঞ্চুরি ক্লাব। ১৯১৩ থেকে তার নাম ‘রামকৃষ্ণপুর সংসদ’, ঠিকানা ১৯০ রামকৃষ্ণপুর লেন। হাওড়ার সংস্কৃতি-চেতনার সঙ্গে নিয়ত চর্চায় জড়িয়ে থাকা এই গ্রন্থাগারের ১২৫ বছরের সূচনা হল। তিন শতাধিক সদস্য, আট হাজারেরও বেশি বই, সবচেয়ে পুরনো বইটি চার্লস ল্যাম্ব সঙ্কলিত স্পেসিমেনস অব ইংলিশ ড্রামাটিক পোয়েটস, হু লিভড অ্যাবাউট দ্য টাইম অব শেক্সপিয়র। তৈরি হয়েছে ডিজিটাল ক্যাটালগ; গত ২৬ জানুয়ারি উদ্বোধন হল প্রতিষ্ঠাতার পৌত্র, বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য নিমাইসাধন বসুর নামাঙ্কিত একটি ফ্রি রিডিং সেন্টারও।
মনে রেখে
পদার্থবিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র, কিন্তু মেধার অনুশীলন তাঁকে নিয়ে গেল গভীরতর চিন্তার দিকে: মানুষের উপর মানুষের অত্যাচার কী ভাবে রোধ করা যাবে? সন্তোষ রাণা ফিরে গেলেন তাঁর প্রান্তিক জগতে, নিজ গ্রামে, গড়ে তুললেন গোপীবল্লভপুর কৃষক আন্দোলন। পথের খোঁজ পরে তাঁকে নিয়ে যায় ভারতে জাতি ও শ্রেণি বিভাজনের সম্পর্কের মতো জরুরি অথচ অবহেলিত দিকটির বিশ্লেষণে। ‘সন্তোষ রাণা স্মারক সমিতি’র আয়োজনে তাঁর নামাঙ্কিত স্মারক বক্তৃতা আজ বিকেল ৪টায় মৌলালি যুবকেন্দ্রে, অনিতা অগ্নিহোত্রী বলবেন বাংলার গণ-আন্দোলনে প্রান্তিক মানুষের ভূমিকা নিয়ে। আর আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি দুপুর সাড়ে ৩টায় অনুষ্টুপ-এর আয়োজনে ৩৩তম ‘সমর সেন স্মারক আলোচনা’ প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে, ‘সভ্যতার সঙ্কট’ নিয়ে বলবেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় দীপেশ চক্রবর্তী ও অনিতা অগ্নিহোত্রী।
পোস্টারে ধরা
১৬৫ অক্সফোর্ড স্ট্রিট, ওয়েস্টমিনস্টার। লন্ডনের এই ঠিকানায় ১৯১৩-তে ‘পিকচার হাউস’, ১৯৩১ থেকে ‘দ্য আকাডেমি’ নামে একটি সিনেমাহলের যাত্রা শুরু। কালক্রমে সে-ই ‘আর্ট হাউস সিনেমা’ দেখানোর পীঠস্থান, ব্রিটিশ দর্শককে পরিচয় করিয়েছে জঁ রেনোয়া ইঙ্গমার বার্গম্যান সত্যজিৎ রায় আন্দ্রে ওয়াইদা জঁ-লুক গদার-সহ বিশ্ববিশ্রুত চলচ্চিত্রকারদের সঙ্গে। ১৯৪৭-৮০, তেত্রিশ বছর ধরে দ্য অ্যাকাডেমি-তে দেখানো বহু ছবির হ্যান্ডপ্রিন্টেড লাইনোকাট পোস্টার এঁকেছেন ব্রিটিশ শিল্পী পিটার স্ট্রসফেল্ড। তাঁর আঁকা সত্যজিৎ-ছবির পোস্টারকে এ বার পিকচার-পোস্টকার্ডের আকারে প্রকাশ করল সিনে সেন্ট্রাল, ‘সত্যজিৎ রায়: দ্য অ্যাকাডেমি সিনেমা পোস্টারস’ নামে। পথের পাঁচালী অপরাজিত জলসাঘর শতরঞ্জ কে খিলাড়ি (ছবি)-সহ সাতটি ছবি, অপূর্ব!
অনন্য জীবন
খবরকাগজের লেখা থেকে প্রথম চেনা। রামচন্দ্র গুহের বই, ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে স্বাধীনতা-উত্তর সংবাদপত্র থেকে কিছু তথ্য, পরে নেহরু মেমোরিয়াল মিউজ়িয়ম অ্যান্ড লাইব্রেরি থেকে স্বাধীন ভারতের প্রথম মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক সুকুমার সেনের (ছবি) কিছু ছবি, সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরি থেকে দেশের প্রথম দু’টি সাধারণ নির্বাচন নিয়ে তাঁর প্রকাশিত রিপোর্ট সংগ্রহ করেন নিলয় সাহা। কোভিডকালে জানতে পারেন ইলেকশন কমিশন অব ইন্ডিয়া আয়োজিত প্রথম ‘সুকুমার সেন স্মারক বক্তৃতা’র কথা, ২০২০-র ২৩ জানুয়ারি যে বক্তৃতা দেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ক্রমে সুকুমার সেনের দৌহিত্রদের সঙ্গে পরিচয়, ওঁর সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত ওঁরা তুলে দেন নিলয়বাবুর হাতে। এরই ফসল ভারতের প্রথম মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক সুকুমার সেন: এক অনন্ত জীবন (প্রকা: রোহিণী নন্দন) নামে নিলয় সাহার লেখা বইটি, এক অনুষ্ঠানে প্রকাশিত হল সম্প্রতি।
তথ্য ও সত্য
আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যখন ইতিহাস চর্চায় তথ্যের শুদ্ধতার থেকে ব্যবহারিক প্রয়োজনের গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে, যেন কোনও মত প্রতিষ্ঠা বা লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা এগিয়ে নিয়ে যাওয়াতেই তথ্যের সার্থকতা। গত ৬ ফেব্রুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটিতে ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী মনে করিয়ে দিলেন, তথ্যের নিজস্ব অবস্থান ও চলন আছে, সে সব সময় নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সিদ্ধির অনুকূল না-ও হতে পারে; ব্যক্তিগত মতবাদের বাধা পেরিয়ে তথ্য ও সত্যের প্রতি সর্বোচ্চ দায়বদ্ধতাই ইতিহাসবিদের আদর্শ। সোসাইটির তরফে যদুনাথ সরকার নামাঙ্কিত স্বর্ণপদক অর্পণ করা হল দীপেশবাবুকে, ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাদার ইতিহাস চর্চার প্রেক্ষাপটে যদুনাথ সরকারের কর্মপদ্ধতি ও দর্শন নিয়ে বললেন তিনি, যদুনাথকে নিয়ে তাঁর লেখা বইয়ের প্রসঙ্গও এল। অন্তরঙ্গ আলাপ, রেশ রয়ে গেল বক্তার গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতেও।