সুরক্ষাহীন: প্রায় ৩০ ফুট উঁচুতে উঠে চলছে মণ্ডপসজ্জার কাজ। কুমোরটুলি এলাকার একটি পুজো মণ্ডপে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
উঁচু থেকে পড়ে কারও হাত-পা ভেঙেছে, কেউ কার্যক্ষমতা হারিয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে প্রচুর। তবু এ শহরে দুর্গাপুজোর মণ্ডপ তৈরির কাজে যুক্ত শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি। অভিযোগ, পুজোকর্তাদের একটা বড় অংশ এখনও শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য বিমা করানো নিয়ে মাথা ঘামান না! বদলে মণ্ডপ থেকে গয়না, প্রতিমা থেকে দর্শনার্থীদের বিমা করালেই পুরস্কার জেতার সুযোগ বাড়তে পারে বলে মনে করেন তাঁরা। এই বিমার অঙ্ক নিয়ে প্রতিযোগিতাও চলে তাঁদের নিজেদের মধ্যে।
পুজো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, মূলত মণ্ডপের বিমাই বেশি করানো হয়। আগুন লাগা, ধস নামা, ভূমিকম্প বা জঙ্গি হামলার মতো ঘটনা ঘটলে মূল মণ্ডপের বিমার ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। তবে সে ক্ষেত্রেও মণ্ডপটি যে উপকরণ দিয়ে তৈরি, তার দাম মেলে ক্ষতিপূরণ হিসাবে। কিন্তু শ্রমিকের খরচ, শিল্পীর খরচ-সহ মণ্ডপ তৈরির বাকি আনুষঙ্গিক খরচের কিছুই মেলে না। এ ক্ষেত্রে আরও বেশ কিছু নিয়ম থাকে। যেমন, বিমা সংস্থাকে আগাম জানাতে হয় যে, মণ্ডপটি কী দিয়ে তৈরি। ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য মণ্ডপ তৈরির উপকরণ কেনার বিল জমা করতে হয়। মণ্ডপের নিরাপত্তা কী রকম ছিল এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে কত জন করে দর্শনার্থীকে মণ্ডপে ঢোকানো হয়েছে— সে সবও দেখা হয়। তবে এর পরেও তৃতীয়া থেকে দশমীর মধ্যে কোনও অঘটন ঘটলে তবেই এই ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়।এখন মহালয়া থেকেই কার্যত পুজো শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সেই সময়ে কিছু ঘটলে তার ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় না। প্রতি এক লক্ষ টাকায় মণ্ডপের বিমার জন্য কমবেশি ২৩৬ টাকা লাগে। আগে প্রতি এক লক্ষ টাকায় এই খরচ ছিল ১৭৭ টাকা। এ ভাবেই কোনও পুজোকর্তা মণ্ডপের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার বিমা করিয়ে রাখেন, কেউ বা আরও বেশি।
তবে ‘বড় দুর্গা’ নিয়ে দেশপ্রিয় পার্কে ২০১৫ সালে জটিলতা তৈরি হওয়ার পরে সামনে আসে দর্শনার্থীদের জন্য বিমার ভাবনা। দর্শনার্থীরা পদপিষ্ট হতে পারেন ভেবে সে বছর দেশপ্রিয় পার্কে তাঁদের প্রবেশের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে পুলিশ। এর পরে করোনা-কালেও নতুন করে দর্শনার্থীদের বিমায় জোর দেওয়া হয়। চলতি বছরে প্রতি এক লক্ষ টাকায় দর্শনার্থীদের বিমার জন্য খরচ পড়ছে কমবেশি ২৩৬ টাকা, যা গত বছর পর্যন্ত ছিল ১১৮ টাকা। অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় প্রায় ১০০ শতাংশ বেড়েছে দর্শনার্থীদের বিমা করানোর খরচ। তবে এ ক্ষেত্রেও মানতে হয় বেশ কিছু নিয়ম। বহু সংস্থা পুজো বিচারে এসে বিমার এই বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নেন বলেই খরচ পড়লেও অনেক পুজো কমিটি এ ব্যাপারে গড়িমসি করেন না। ফোরাম ফর দুর্গোৎসবের সাধারণ সম্পাদক তথা হাতিবাগান সর্বজনীনের পুজোকর্তা শাশ্বত বসু বললেন, ‘‘যে যা-ই বলুন, পুরস্কার তো একটা ব্যাপার বটেই। দর্শনার্থীদের বিমা রয়েছে জানলে বিচারকেরাও প্রভাবিত হন।’’
কিন্তু শ্রমিকের বিমার খরচ কেমন? দীর্ঘদিন থেকে কলকাতার পুজোয় বিমা করানো একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মী অশোককুমার দাস বললেন, ‘‘প্রতি এক লক্ষ টাকার বিমার জন্য বিমা সংস্থাকে ৪৫০০ টাকা মতো দিতে হয়। কিন্তু এ নিয়ে তেমন সচেতনতাই নেই। দুর্ঘটনার ঝুঁকি যে হেতু বেশি, যখন-তখন টাকা দিতে হতে পারে, এই ভেবে বিমা সংস্থাও সে ভাবে প্রচার চালাতে চায় না।’’ তা হলে শ্রমিকদের নিয়ে ভাববেন কারা? পুজোকর্তারা অনেকেই এ নিয়ে স্পষ্ট মন্তব্য করতে চাননি। সুরুচি সঙ্ঘের পুজোকর্তা কিংশুক মৈত্র বললেন, ‘‘সব ধরনের বিমাই থাকে, ফলে সমস্যা তেমন হয় না।’’ একই রকম দাবি চেতলা অগ্রণীর পুজোকর্তা সমীর ঘোষের। শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের পুজোকর্তা দিব্যেন্দু গোস্বামী আবার বললেন, ‘‘এটা পুজো কমিটির বিষয় নয়, শ্রমিকদের কন্ট্রাক্টর বুঝবেন।’’ যদিও সচেতন পুজো চোরবাগান সর্বজনীনের কর্তা জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘গত বছর আমাদের মণ্ডপেই এক শ্রমিক পড়ে আহত হয়েছিলেন। এ বার তাই ৬০ জন শ্রমিকের প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে এক লক্ষ টাকার বিমা করিয়ে রেখেছি।’’