নজরে: প্রৌঢ় দম্পতিকে খুনের ঘটনা ঘটার পরে সারানো হচ্ছে বিকল সিসি ক্যামেরা। মঙ্গলবার, ভবানীপুরে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
কখনও টাকা-গয়না লুটের জন্য, কখনও নিঃসঙ্গ প্রবীণ-প্রবীণার জমি-বাড়ি হাতিয়ে নিতে, কখনও আবার পারিবারিক শত্রুতার কারণে! শহরে বয়স্কদের খুনের ঘটনার পিছনে গত কয়েক বছর ধরে এমনই প্রবণতা দেখা গিয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় ভবানীপুরের হরিশ মুখার্জি রোডে এক প্রৌঢ় দম্পতির খুনের ঘটনা সামনে আসতেই আরও একটু দীর্ঘ হল সেই তালিকা। ফের প্রশ্ন উঠল, এ শহর বয়স্কদের জন্য কতটা নিরাপদ?
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেই শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিটের একটি অতিথিশালা থেকে উদ্ধার হয় বছর তেষট্টির স্বর্ণ ব্যবসায়ী শান্তিলাল বৈদের দেহ। সেখানে তাঁকে খুন করে রেখে মুক্তিপণ হাতিয়ে চম্পট দেয় এক যুবক। তদন্তে নেমে পুলিশ দিন পনেরো বাদে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে। জানা যায়, টাকা হাতানোর জন্যই ওই প্রৌঢ়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে অভিযুক্ত। যুবকের সঙ্গে ওই অতিথিশালায় গিয়েছিলেন শান্তিলাল। এ দিকে পুলিশ দাবি করে, তাদের জানানোর আগেই প্রৌঢ়ের পরিবার মুক্তিপণের টাকা যুবককে দিয়ে দেয়।
গত নভেম্বরে শেক্সপিয়র সরণির এক বহুতলে খুন হন রেণুকা চৌধুরী নামে এক বৃদ্ধা। ৯১ বছরের ওইবৃদ্ধা ছেলের সঙ্গে থাকতেন। ঘটনার সময়ে ছেলে বাড়িতে ছিলেন না। তদন্তে নেমে পুলিশ গ্রেফতারকরে বৃদ্ধার প্রাক্তন গাড়িচালককে। পুলিশ জানায়, আগের দিন বহুতল চত্বরে ঢুকে গা ঢাকা দিয়ে ছিল চালক। সুযোগ বুঝে সে বৃদ্ধার ফ্ল্যাটে চলে যায়। পরিচিত লোক হওয়ায় বৃদ্ধা তাকে দরজা খুলে দেন। শ্বাসরোধ করে বৃদ্ধাকে খুন করে টাকা-গয়না নিয়ে চম্পট দেয় সে।
গত বছরের শুরুতে খুন হন বৌবাজারের ফিয়ার্স লেনের বাসিন্দা আয়ুব ফিদা আলি আঘা। বছর পঁচাত্তরের ওই বৃদ্ধ মেয়ের সঙ্গে থাকতেন। ছেলে বিয়ের পরে আলাদা থাকছিলেন। স্ট্র্যান্ড রোডে তাঁদের দোকান সামলাতেন বাবা-ছেলে। চা দিতে গিয়ে শ্বশুরের দেহ প্রথম দেখেন আয়ুবের পুত্রবধূ। মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাতের পাশাপাশি গলার নলি কাটা ছিল বৃদ্ধের। লন্ডভন্ড ঘর থেকে টাকা-গয়না এবং জমি-বাড়ি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরি যায় বলে পরিবারের দাবি। সেই ঘটনায় আজও কেউ গ্রেফতার হয়নি।
২০১৯ সালেও টাকা-গয়না লুট করতে দু’টি খুনের ঘটনা ঘটে বেহালা এবং নেতাজিনগরে। নেতাজিনগরে খুন হন বয়স্ক দম্পতি। বাড়ির একতলায় বৃদ্ধার এবং উপরে বৃদ্ধের মৃতদেহ মেলে। তদন্তে জানা যায়, শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে দম্পতিকে। গ্রেফতার করা হয় ওই বাড়িতে কাজ করে যাওয়া রঙের এক মিস্ত্রিকে। নিঃসন্তান দম্পতির জমি-বাড়ি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টার অভিযোগও সামনে আসে। বেহালার ঘটনায় আবার ৮০ বছরের বৃদ্ধাকে খুন করে কিছু দিন আগে রঙের মিস্ত্রির সঙ্গে বৃদ্ধার বাড়িতে ঘুরে যাওয়া এক যুবক। পরিচিত হওয়ার সূত্রে বাড়িতে ঢুকে টাকা-গয়না লুটের চেষ্টা করে তারা। বৃদ্ধা দেখে ফেলায় তাঁকে শ্বাসরোধ করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়। ওই সময়ে থানা স্তরে বয়স্কদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর নির্দেশ দেন পুলিশ কমিশনার।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের ঘটনা। তদন্তে উঠে আসে, নতুন সম্পর্ক তৈরির পথে বাধা হওয়ায় এক বৃদ্ধাকে নৃশংস ভাবে খুন করে পুত্রবধূ, বৌমারপ্রেমিক এবং নাতনি। গড়িয়াহাটের গড়চা ফার্স্ট লেনের বাসিন্দা বৃদ্ধার খুনে গ্রেফতার করা হয় ওই তিন জনকে। তদন্তকারীরা জানান, বৃদ্ধার সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার থেকেও নতুন সম্পর্কের বাধা কাটাতেই এই খুনের পরিকল্পনা।
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক আধিকারিকের মন্তব্য, ‘‘বয়স্কদের নিয়ে আমরা যথেষ্টতৎপর। প্রবীণদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর নির্দেশ থানাগুলিকেদেওয়া রয়েছে। অতীতে যে কোনও অপরাধে দ্রুত কিনারা করার চেষ্টা হয়েছে। হরিশ মুখার্জি রোডের ঘটনাতেও সেটাই হবে।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।