পানি-পথ: প্রবল বৃষ্টিতে জলমগ্ন শহর। বুধবার রাতে, পার্ক সার্কাসের কাছে। নিজস্ব চিত্র
জল কেটে কেটে একটা খাঁড়ি থেকে আর একটা খাঁড়িতে ঢুকছি আর দু’পাশে জলের উপরে জেগে রয়েছে গাছ। শৌখিন টুরিস্টের মরসুমি সুন্দরবন ভ্রমণ নয়, খাস কলকাতার রাস্তা। গাছের পাশ দিয়ে, গাছের তলা দিয়ে, গাছের ডালপালা সরিয়ে-মাড়িয়ে, কোনাকুনি করে পাশ কাটিয়ে যেন শুঁড়িপথ দিয়ে চলেছি। কোথাও আলো, কোথাও অন্ধকার। ফলে আগে থেকে ঠিক আন্দাজও পাওয়া যাচ্ছে। কোন নিকষ কালোর মধ্যে কোন মহীরুহের ভূলুণ্ঠিত শবদেহ পথ আগলে দাঁড়াবে, বোঝা যাচ্ছে না আগাম।
বুধবার রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ একটা গাড়ি পাওয়া গিয়েছিল অফিস থেকে। দক্ষিণের পাঁচ জন তাতে উঠেছি। ফুলন্ত কদমগাছ উপড়ে গিয়ে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট থেকে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে বেরোনোর রাস্তা বন্ধ। ম্যাডান স্ট্রিট বন্ধ। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে গাছ পড়ার খবর আগে থেকেই জানি। তাকেই পাশ কাটিয়ে অন্য ধার দিয়ে এগোনো গেল। ফিরপো ছাড়িয়েই আবার গাছ। গাড়ি ঘুরিয়ে তখন লিন্ডসে স্ট্রিট। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ওঠা গেল না তবু। ডান দিকের একটা গলি ধরে কিড স্ট্রিট। সেখানেও থামতে হল। খানিক এ ধার-ও ধার করে কোনও মতে ওঠা গেল রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডে। মিনিট পাঁচেক এগিয়ে আবার গাছ।
ছিন্নমূল সব বনস্পতি আর সিগন্যাল পোস্ট। এ শহরে গাছেদের একটা প্রজন্ম শেষ হয়ে গেল আমপানে। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, বকুল, জারুল, কদম... আরও কত। দীপাবলির সরু মোমবাতি যেমন এক এক জন নুয়ে পড়ে হঠাৎ, কোমর মুচড়ে শুয়ে থাকা সিগন্যাল পোস্টগুলোকে দেখে ঠিক ওই রকম লাগছিল।
প্রায় দু’মাস ধরে লকডাউনে শহরটা এমনিতেই ভুতুড়ে হয়ে আছে। আমপানের রাত যেন প্রেতপুরীর রাত। ভারী বৃষ্টি, কালবৈশাখী, জল জমা, গাছ পড়া কিছুই নতুন কথা নয় কলকাতায়। বৃষ্টি থামলে জল ঠেলে ছেলেপুলের হুল্লোড়, গাছ সরাতে পুরকর্মীদের ব্যস্ততা, ভাঙা দোকানের কাঠামো সরাতে স্থানীয় মানুষের তৎপরতা— এ সবেই অভ্যস্ত ছিল চোখ। রাত হলেও প্রাণস্পন্দন থেমে যেত না শহরের। এ রাত একেবারে আলাদা। সাড়হীন, স্থাণু। মাঝেমধ্যে দু’একটা পুলিশের গাড়ি আর বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একটা কী দুটো লোক। নিঃশব্দ, নিঃসঙ্গ। আত্মসমর্পিত। এত থম মেরে যাওয়া, এত বাকশূন্য কলকাতা দেখতে হয়নি আগে।
এক সহকর্মী জিপিএস অন করে জানালেন, গাড়ি ঘুরিয়ে এলিয়ট রোডে ওঠা যাবে। ওটা ফাঁকা দেখাচ্ছে। ফাঁকা মানে নিষ্প্রদীপ জলপথ। গাছ নেই, শুধু জলরাশি। বিদ্যুতের ছেঁড়া তার কালো সাপের মতো মাঝে মাঝে হেডলাইটের আলোয় চোখের সামনে দুলে উঠছে। কসবা থেকে ই এম বাইপাস যাওয়া যে এত কঠিন হতে পারে, কে ভেবেছিল! গোটা শহরে যেন বাঘবন্দি খেলার অদৃশ্য ছক কেটে রেখেছে কেউ। কসবা কানেক্টর বন্ধ। বি বি চ্যাটার্জি স্ট্রিট, ফার্ন রোড বন্ধ। ঢাকুরিয়া সেতুতে ওঠা যাচ্ছে না। পূর্ণদাস রোড, সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে ঢোকা যাচ্ছে না। আবার ঘুরে পার্ক সার্কাস থেকে মা উড়ালপুল ধরতে হবে।
কলকাতা চুপ করে গিয়েছে। সিগন্যালের বাতিরা শুধু জ্বলছে-নিভছে। টিকটিকির লেজের মতো কাটা পড়েও নড়ছে। রাস্তায় পড়া গাছের ঝাঁকড়া পাতার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে লাল আলো। ভূপতিত সিগন্যাল পোস্ট তার কাজ করে যাচ্ছে। যেন ডুবন্ত টাইটানিকের বেহালাবাদক।
আলো হলুদ হয়ে সবুজ হল।