—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
ক্রমশ সক্রিয় হতে শুরু করেছে মাম্পস ভাইরাস। যার ফলে আচমকা মাম্পস রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। শহর থেকে জেলা, সর্বত্রই শিশুরোগ চিকিৎসকদের কাছে ভিড় বাড়ছে আক্রান্তদের। কারও কারও আবার এতটাই বাড়াবাড়ি হচ্ছে যে, আইসিইউ-তে রেখে চিকিৎসা করতে হচ্ছে। চিকিৎসকদের কথায়, ‘‘সারা দেশেই মাম্পসের প্রকোপ বেড়েছে। কার্যত মহামারির পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে।’’
শিশুরোগ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এ রাজ্যের পাশাপাশি কেরল, মহারাষ্ট্রেও মাম্পস ভাইরাসের দাপট বৃদ্ধির খবর মিলছে। যার নেপথ্যে রোগটিকে অবহেলা করার মনোভাবই আসল কারণ বলে মত চিকিৎসকদের। কারণ, ওই রোগের কোনও প্রতিষেধক সরকারি স্তরে শিশুদের দেওয়া হয় না। আর প্রতি ১০০টি শিশুর মধ্যে অন্তত ৭০-৮০ জন সরকারি হাসপাতাল থেকেই বিভিন্ন প্রতিষেধক নেয়। রাজ্যের এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে হাম ও রুবেলার প্রতিষেধক (এমআর ভ্যাকসিন) দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে মাম্পস ভাইরাসের কোনও প্রতিষেধক নেই। যদিও বেসরকারি স্তরে তিনটি ভাইরাসেরই একসঙ্গে প্রতিষেধক (এমএমআর) পাওয়া যায়।’’
শেষ কয়েক মাস ধরে মাম্পসের প্রকোপ বৃদ্ধির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে সরকারি স্তরেও এমএমআর প্রতিষেধক চালুর বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রককে চিঠি দিয়েছেন ‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স’-এর সভাপতি তথা কর্নাটকের শিশুরোগ চিকিৎসক জি ভি বাসব রাজা এবং
সম্পাদক তথা গুজরাতের শিশুরোগ চিকিৎসক যোগেশ পারিখ। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, মাম্পস ভাইরাস অত্যন্ত সংক্রামক। ড্রপলেটের মাধ্যমে, অর্থাৎ আক্রান্তের হাঁচি, কাশি বা কথা বলার সময়ে মুখ থেকে বেরোনো থুতু থেকে ওই ভাইরাস ছড়ায়। গুজরাতের শিশুরোগ চিকিৎসক ইমরান পটেল বলছেন, ‘‘আক্রান্ত বাচ্চাদের অনেকেই স্কুলে যায়, কিংবা কোথাও খেলাধুলো করতে যায়। সেখানেই এক জনের থেকে আরও বহু শিশুর মধ্যে মাম্পস ভাইরাস সহজে ছড়িয়ে পড়ে।’’ দিনকয়েক ধরে প্রকোপ খানিকটা কমলেও গত মাসে প্রতিদিন ১০-১৫ জন মাম্পস আক্রান্ত শিশু তাঁর কাছে এসেছে। তাই আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে কখন আবার প্রকোপ মাথাচাড়া দেবে, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় বলেই মত ইমরানের।
মাম্পস ভাইরাসের বিরুদ্ধে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ না থাকার কারণেই আচমকা সেটির বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছে বলে জানাচ্ছেন ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথের (আইসিএইচ) শিশুরোগ চিকিৎসক প্রভাসপ্রসূন গিরি। তিনি আরও বলেন, ‘‘যে কোনও
সংক্রামক অসুখকে দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষা করলে এমন ফল মেলা স্বাভাবিক। এর নির্দিষ্ট কোনও ওষুধও নেই। উপসর্গ অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়।’’ ওই ভাইরাসের কারণে দুই থেকে ১৪ বছর বয়সিদের গলার প্যারোটিড গ্রন্থি ফুলে যাচ্ছে। কারও কারও প্রথমে এক দিকে দেখা গেলেও পরে আর এক দিকেও হচ্ছে। তাতে গলা ব্যথা, খেতে না পারা, জ্বরের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। এই মুহূর্তে আইসিএইচের আইসিইউ-তে মাম্পস ভাইরাসের কারণে বাড়াবাড়ি রকমের অসুস্থতা নিয়ে একটি শিশু চিকিৎসাধীন। মাম্পসে আক্রান্ত অনেক শিশুরই মেনিনজাইটিস, এনসেফ্যালাইটিস, অর্থাৎ মস্তিষ্কে প্রদাহ ও অণ্ডকোষে প্রদাহ, প্যানক্রিয়াটাইটিসের সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের শিশুরোগ চিকিৎসক দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী। আর এই ভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধির নেপথ্যে পদ্ধতিগত ভুলের কথা বলছেন ‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স’-এর কোষাধ্যক্ষ তথা রাজ্যের শিশুরোগ চিকিৎসক অতনু ভদ্র। তাঁর কথায়, ‘‘দেশ জুড়েই সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এটা স্পষ্ট যে, সরকারি স্তরে শুধু হাম ও রুবেলার প্রতিষেধক দেওয়া ঠিক হয়নি। যেখানে তিনটি প্রতিষেধক একসঙ্গে পাওয়া যায়, সেখানে অবিলম্বে সেটি সরকারি প্রতিষেধক নীতির মধ্যে আনা জরুরি।’’
সরকারি স্তরে প্রথমে শুধু হামের প্রতিষেধক দেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে ২০২০-র মধ্যে রুবেলা দূরীকরণের লক্ষ্যে সেটিও যুক্ত করা হয় বলে জানাচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই। তিনি বলেন, ‘‘হাম ও রুবেলা দূরীকরণ কর্মসূচিতে দেখা যায়, এমআর ভ্যাকসিন দেওয়ার ফলে দেশে হাম প্রায় ৬০ শতাংশ এবং রুবেলা ৫০ শতাংশ কমেছে। আসলে নীতি-নির্ধারকদের একাংশ মনে করেছিলেন, হাম বা রুবেলার ক্ষতি অনেক বেশি, তাতে প্রাণসংশয়ও হতে পারে। কিন্তু মাম্পসের ক্ষতির দিকটিও কম কিছু নয়। সেটি নিয়েও ভাবার সময় এসেছে।’’