সারিবদ্ধ: রোগীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে অ্যাম্বুল্যান্স। শুক্রবার, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে। নিজস্ব চিত্র।
বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের ইচ্ছেমতো দর হাঁকার রোগ নিয়ন্ত্রণ করবে কে? বৃহস্পতিবার জলপাইগুড়ি সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালের ঘটনার পরে রাজ্য জুড়ে উঠেছে এই প্রশ্ন। কারণ, জেলা থেকে শহর, সর্বত্রই বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের নিয়ন্ত্রণ কারও হাতেই নেই। অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের যেমন খুশি দর হাঁকানিয়ে রোগীর পরিজনেরা অভিযোগ করলে অধিকাংশ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই জানান, এ বিষয়ে তাঁদের কিছু করণীয় নেই। জলপাইগুড়িতে অ্যাম্বুল্যান্স মাত্রাতিরিক্ত দর হাঁকায় মায়ের মৃতদেহ কাঁধে করেই বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন ছেলে। স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশে সেই ঘটনার তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গড়েছে হাসপাতাল।
কিন্তু প্রশ্ন হল, দিনের পর দিন একই ভাবে রাজ্যের সর্বত্র অ্যাম্বুল্যান্সের এই ‘দাদাগিরি’চললেও তা স্বাস্থ্য দফতর নিয়ন্ত্রণ করে না কেন? রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার দাবি, ‘‘সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই। কারণ, তেমন কোনও আইন বা নির্দেশিকা, কিছুই নেই।’’ ভুক্তভোগীদের একাংশের প্রশ্ন, বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে স্বাস্থ্য দফতর। তাদের নির্দেশিকা বা নিয়ম মেনেই চলতে হয় নার্সিংহোম, বেসরকারি হাসপাতাল বা ল্যাবরেটরিগুলিকে। তা যদি হতে পারে, তা হলে অ্যাম্বুল্যান্সের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে থাকবে না কেন? কেনই বা সরকারি নির্দেশিকা বলবৎ হবে না?
এর সদুত্তর অবশ্য কারও কাছেই নেই। ২০১৮ সালে বীরভূমের বাসিন্দা এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে বর্ধমান থেকে কলকাতায় আনার সময়ে অ্যাম্বুল্যান্সেই তার মৃত্যু হয়। পরে জানা গিয়েছিল, ওই ‘আইসিইউ’ অ্যাম্বুল্যান্সে চিকিৎসক বলে যাঁকে দেখানো হয়েছিল, তিনি আদতে এসি মিস্ত্রি। সেইঘটনার পরে অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবাকে ‘রাজ্য ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট রেগুলেটরি কমিশন’-এর আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। রাজ্য স্বাস্থ্য কমিশনের চেয়ারম্যান অসীম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কোভিডের সময়ে অ্যাডভাইজ়রি জারি করে অ্যাম্বুল্যান্সের খরচ বেঁধে দিয়েছিলাম। জলপাইগুড়ির বিষয়টিও আমাদের নজরে এসেছে। অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
কোভিডের সময়ে নির্দেশিকা যা-ই থাক, এক শ্রেণির চালক মর্জি মতো দর হেঁকেছেন বলেই অভিযোগ। এখনও প্রতিদিন যে কোনও সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালের সামনে গেলে এমন অভিযোগ ভূরি ভূরি শোনা যায়।
এই আর্থিক হেনস্থা রুখতে কারও কি কিছুই করার নেই?
স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, সরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মানতে হয়। কিছু বেসরকারি হাসপাতালের নিজস্ব অ্যাম্বুল্যান্স রয়েছে। কিন্তু বাদবাকি বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের ক্ষেত্রে শুধু পরিবহণ দফতরের রেজিস্ট্রেশন এবং সেটি অ্যাম্বুল্যান্স কি না, তা প্রমাণ করলেই রাস্তায় নামানো যায়। ওই আধিকারিকের কথায়, ‘‘অ্যাম্বুল্যান্সগুলির স্বাস্থ্য ঠিক আছে কি না, সেটাই বহু ক্ষেত্রে লাখ টাকারপ্রশ্ন। কিন্তু কোনও নির্দেশিকা না থাকায় কেউ পরীক্ষাও করে না। আর কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই বলে ভাড়াও মর্জিমতো চাওয়া হয়।’’
শুধুমাত্র প্রসূতিদের জন্য রাজ্য সরকারের ‘১০২ অ্যাম্বুল্যান্স’ পরিষেবা রয়েছে। সেটি কেন্দ্রীয় ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আবারকলকাতা বাদে অন্যান্য জেলার ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে ‘নিশ্চয়যান’ পরিষেবা। সেগুলিও শুধু প্রসূতিদের পরিষেবা দেয়।রাজ্যে এই মুহূর্তে ৯০০টি ‘১০২ অ্যাম্বুল্যান্স’ এবং ২২০০টি ‘নিশ্চয়যান’ রয়েছে। কিন্তু বহু সময়েই ওই অ্যাম্বুল্যান্স না পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। আর অন্য রোগীদের ভরসা বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স।সেখানেই চলে অলিখিত সিন্ডিকেট। প্রতিটি হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, নিরাপত্তারক্ষী, এমনকি,যেখানে ডিসচার্জ বা ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়, সেখানে থাকেবেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স ও শববাহী গাড়ির চালকদের নম্বর। তাঁরাই রোগীর পরিজনদের সেই সব গাড়ি পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এর জন্য মেলে কমিশনও।
শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে ঘোরা এক অ্যাম্বুল্যান্স চালকের কথায়, ‘‘কমিশন না দিলে তো ভাড়াইপাব না। তাই জায়গা মতো একটা ভাড়া চেয়ে নিই। কেউ দরদাম করলে কিছুটা কমিয়েও দিই।’’ এক রোগীর পরিজন বলছেন, ‘‘ট্যাক্সিতেও নির্দিষ্ট রেট চার্ট থাকে। অ্যাম্বুল্যান্সে তা না থাকায় কলকাতার হাসপাতাল থেকে জেলায় যেতে কেউ এক, কেউ বা দু’হাজার হাঁকছেন। আর সব জেনেও প্রশাসন চুপ!’’